রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব এসেছে। প্রস্তাবগুলি যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা এই রাজ্যের হাসপাতাল, ক্লিনিক, পরীক্ষার ল্যাবরেটরি, নার্সিং কলেজ-সহ স্বাস্থ্য পরিষেবা-সংক্রান্ত নানা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। এ রাজ্যের বাণিজ্য-পরিমণ্ডল জেনেই তাঁরা নতুন বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন। রাজ্যবাসীর কাছেও তাঁরা সম্পূর্ণ অপরিচিত নন। বৃহৎ সংস্থার বিপুল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিতে ভরসা করতে যাঁরা নারাজ, তাঁরাও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের এই প্রস্তাবগুলিতে আশান্বিত হতে পারেন। এই প্রস্তাবগুলির তাৎপর্য কেবল নিয়োগের সম্ভাবনা দিয়েও বিচার করা চলে না। প্রস্তাব অনুসারে নতুন মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং কলেজ তৈরি হলে উচ্চশিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা, দু’দিকেই নতুন সুযোগ তৈরি হবে। রাজ্যে চিকিৎসকের চাহিদা যেমন আছে, তেমনই চাহিদা রয়েছে মেডিক্যাল ও নার্সিং-এর আসনের। কিন্তু ভারতে মেডিক্যাল শিক্ষার নিয়মবিধি, এবং বিনিয়োগের অভাব তরুণদের স্বপ্নের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিল এত দিন। গত কয়েক বছরে মেডিক্যাল শিক্ষা-নীতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে, প্রতিটি জেলায় মেডিক্যাল কলেজ তৈরির লক্ষ্য জাতীয় স্তরে গৃহীত হয়েছে। এ রাজ্যের কয়েকটি জেলায় ইতিমধ্যেই সরকারি মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হয়েছে। এখন সারা রাজ্যে তার বিস্তার প্রয়োজন। সেই বিপুল খরচের দায়ভার আংশিক গ্রহণের জন্য বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণের প্রয়োজন আছে অবশ্যই। সর্বোপরি, জেলাস্তরের হাসপাতালগুলিকে উন্নীত করতে চার হাজার কোটি টাকার বেসরকারি বিনিয়োগ যদি সত্যিই হয়, তা হলে জেলার চিকিৎসাব্যবস্থার ধমনীতে নতুন রক্তসঞ্চালন হবে। উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতা আসার প্রয়োজন কমবে। নানা স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের সুযোগ ও মানও বাড়বে, ফলে রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা, দু’দিকেরই উন্নতি হবে। এর মূল্য রাজ্যের কাছেও কম নয়— মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জোগান সর্বাধিক প্রয়োজন।
তবে, প্রশ্নও আছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলির মান সারা ভারতেই সরকারি কলেজের তুলনায় খারাপ। উপরন্তু, সেগুলি অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। তাই মেডিক্যাল শিক্ষার সুযোগে সামাজিক ন্যায় কতটা সুরক্ষিত থাকছে, সে প্রশ্নও উঠেছে। ভারতে এখনই প্রায় অর্ধেক মেডিক্যাল আসন রয়েছে প্রাইভেট কলেজে, আগামী দিনে সেইগুলিতেই আসনসংখ্যা দ্রুত বাড়বে। জাতীয় মেডিক্যাল কমিশন ঘোষণা করেছে, প্রাইভেট কলেজগুলিতে অন্তত অর্ধেক আসনের ফি সরকারি কলেজের সমান রাখতে হবে। আগামী বছর থেকে এমন নিয়ম কার্যকর হবে। উত্তম উদ্যোগ, তবে অতীতে দেখা গিয়েছে, সরকারি নিয়মবিধি দিয়ে বেসরকারি কলেজগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। মেডিক্যাল শিক্ষার পরিকাঠামো সংক্রান্ত বিধির পালন, বা পঠন-পাঠন, চিকিৎসা প্রভৃতির নির্ধারিত মূল্য গ্রহণ, কোনওটিই মেনে চলতে আগ্রহী নয় প্রাইভেট কলেজগুলি। ফলে সুলভে শিক্ষা বা চিকিৎসা, কোনও লক্ষ্যই সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
অতএব বিনিয়োগ পাওয়ার পরেও উন্নত শিক্ষা, জনমুখী চিকিৎসা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের থেকেই যায়। তার জন্য সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলির শিক্ষার মান উন্নত করা দরকার, কারণ সেগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতাই বেসরকারি কলেজের উৎকর্ষের পথ। সেই উদ্দেশ্যে মেডিক্যাল কলেজগুলির স্বাধিকারের সুরক্ষা, স্বাস্থ্যভবনের খবরদারিতে রাশ টানা, এবং স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা প্রয়োজন। উন্নয়ন আনতে মুক্ত বাজারের সুবিধে চাইলে বাজারের নিয়মবিধি মানতে হবে সরকারকেও। হতে হবে সংযত, শক্তিপ্রদর্শন-বিমুখ। না হলে হিতে বিপরীত হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy