মহারাষ্ট্রে যুযুধান দুই পক্ষের নির্বাচনী ইস্তাহার পড়ে মুচকি হাসতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপির ‘সঙ্কল্প পত্র’ বলছে, দল ক্ষমতায় ফিরলে মহিলাদের প্রতি মাসে ২১০০ টাকা দেবে। কংগ্রেস-এনসিপি-শিবসেনা (ইউবিটি)’র জোটের প্রতিশ্রুতিতে অঙ্কটি আরও বেশি— মাসে ৩০০০ টাকা। ভোটের ময়দানে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পটির সাফল্যের এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর হয় কি, যেখানে ‘রেউড়ি রাজনীতি’র কঠোর সমালোচক নরেন্দ্র মোদীর দলই বিপুলতর রেউড়ির ঝুড়ি হাতে মাঠে নেমেছে? অবশ্য, ভারতীয় রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা নরেন্দ্র মোদীর খয়রাতি বিরোধিতার একটি ছক এত দিনে ধরতে পেরেছেন— যে রাজ্যে অন্য দল ক্ষমতাসীন, অথবা যে প্রকল্প পূর্বতন ইউপিএ জমানার, সে সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী রেউড়ির ঘোর বিরোধী; কিন্তু ভোটের প্রয়োজনে তাঁর দল সেই এক নীতি অবলম্বন করলে তিনি মৌন অবলম্বন করেন। মৌনকে কেউ সম্মতির লক্ষণ হিসাবে গণনা করলে প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত আপত্তি করবেন না। যেমন, দিল্লিতে আপ সরকার যখন বিদ্যুতের বিলের উপরে ভর্তুকি দেয়, বিজেপি তখন তার ঘোর বিরোধী; কিন্তু মহারাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিতে বিলে ৩০ শতাংশ ভর্তুকির কথা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার্থীদের ট্যাব দেওয়ার নীতি বা কন্যাশ্রীর তীব্র বিরোধী হলেও মহারাষ্ট্রে দশ লক্ষ শিক্ষার্থীকে মাসে দশ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি। মহা বিকাশ আঘাড়ীর ইস্তাহারে আবার কর্নাটকের ধাঁচে মেয়েদের জন্য নিখরচায় বাস পরিষেবা, কৃষকদের ঋণ পরিশোধে সহায়তা ইত্যাদির কথা আছে। মোট কথা, নির্বাচনী মরসুমে কোনও দলই খয়রাতির অস্ত্রটিকে হাতছাড়া করতে নারাজ। প্রায় নিলাম ডাকার ভঙ্গিতে দর চড়ছে।
এতে সাধারণ মানুষের লাভ, সন্দেহ নেই। দু’পক্ষ নিলাম ডাকলে শেষ অবধি তাঁরা সর্বোচ্চ দরটি পাবেন— অন্তত অর্থশাস্ত্রের যুক্তি সে কথাই বলে। ‘ঝোলাওয়ালা অর্থনীতি’র তাত্ত্বিকরা মনে করিয়ে দেবেন, তাতে এক দিকে ক্রমবর্ধমান অসাম্য খানিক হলেও কমে; আর অন্য দিকে সামগ্রিক অর্থব্যবস্থারও লাভ। দরিদ্র মানুষের হাতে যে টাকা পৌঁছয়, তার সিংহভাগ বা সম্পূর্ণটাই খরচ হয় ভোগব্যয়ে— গরিব মানুষ খয়রাতির টাকায় সাধারণত সঞ্চয় করেন না। অনেক মানুষের ভোগব্যয় খানিকটা করে বাড়লেও অর্থব্যবস্থায় তৈরি হয় বিপুল চাহিদা। তার ফলে উৎপাদন গতিশীল হয়, কলকারখানায় শ্রমিকের চাহিদা বাড়ে, নতুন কর্মসংস্থান হয়। যাঁরা নতুন কাজে নিযুক্ত হন, অথবা যাঁদের বেতন বাড়ে, তাঁদের ভোগব্যয়ের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়, ফলে আরও এক দফা চাহিদা বৃদ্ধি ঘটে। এই ভাবে অর্থব্যবস্থা পৌঁছে যায় উচ্চতর চাহিদা ও বিনিয়োগের কক্ষপথে। তাতে জিডিপির বৃদ্ধির হারও বাড়ে। ঝোলাওয়ালা অর্থশাস্ত্রীরা বলবেন, অসাম্য হ্রাসের কথায় যাঁদের মন ওঠে না, জিডিপির বৃদ্ধির হার বাড়ার সম্ভাবনায় নিশ্চয়ই তাঁরাও উদ্বুদ্ধ হবেন।
যুক্তিটি অন্তঃসারশূন্য, সে কথা বলা চলে না। ভারতে আর্থিক অসাম্য যে স্তরে পৌঁছেছে, তাতে সম্পদের পুনর্বণ্টনের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। কিন্তু, খয়রাতির পথে হাঁটার বিপদের কথাটিও মাথায় রাখা প্রয়োজন। যে কোনও সরকারেরই আর্থিক ক্ষমতা সীমিত— রাজ্য সরকারগুলির তো বটেই। খয়রাতিবাবদ ব্যয়ের পরিমাণ যত বাড়ে, পরিকাঠামোর মতো ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের বিনিয়োগ করার ক্ষমতা ততই হ্রাস পায়। পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা এই কথাটির পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। পরিকাঠামোর উন্নতি না-ঘটলে তা আর্থিক বৃদ্ধির পক্ষে বৃহত্তম বাধা। চাহিদা যতই বাড়ুক, যথেষ্ট বাহ্যিক পরিকাঠামো না থাকলে বিনিয়োগ ততখানি বাড়ে না; এবং, যতটুকু বিনিয়োগ হয়, পরিকাঠামোর ঘাটতি তারও কুশলতা কমায়। কাজেই, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক খয়রাতির খেলায় নামার সময় দলগুলি যদি এই ভারসাম্যের কথা বিস্মৃত হয়, তবে তা নিতান্তই দূরদৃষ্টিহীনতা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy