বিজেপি দলটির রাজনৈতিক সাফল্যের পিছনে আদর্শ, উদ্দেশ্য, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব যতখানি গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয়, অঙ্ক, সংখ্যাতত্ত্ব, কৌশলনীতি ততটা হয় কি? অথচ মহারাষ্ট্রের ঘটনা আবারও উজ্জ্বল প্রমাণ, সেগুলি কী ভাবে সাফল্য এনে দেয় বিজেপিকে। প্রথম থেকে শিবসেনা-পরিচালিত সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখা, বিভাজন ঘটানো, বিক্ষুব্ধ ও বিভক্ত দলকে দূর থেকে চালনা করা, প্রতিটি পদক্ষেপ অঙ্কের মাপে নেওয়া, এবং শেষ রাত্রে কৌটিল্যসুলভ ওস্তাদের মারে শিবসেনা সরকারকে ফেলে দিয়ে, নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মুখ হিসাবে বিজেপি নেতা ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীসকে সামনে না এনে সেই বিক্ষুব্ধ-শিরোমণি একনাথ শিন্ডেকেই শীর্ষপদে বসানো— সব কিছুর মধ্যেই কৌশল পরিষ্কার। বিজেপিই যে সমগ্র কুনাট্যের প্রধান পালাকার, তা নিয়ে প্রথম থেকেই সংশয় নেই। তবু মহারাষ্ট্রের পূর্বতন বিজেপি সরকারের মুখ ফডণবীসকে সামনে আনা হল না— যাতে পুরনো বিজেপি সরকারের ব্যর্থতার ঝুলিটি আর না বইতে হয়। ভারতের রাজনীতি চিত্রটি খুঁটিয়ে দেখে এমন আর একটি দলও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ, যারা এতখানি কৌশল-মনস্ক, দলের ভিতরকার রেষারেষি, দ্বেষাদ্বেষি সামাল দিয়েও এতখানি সঙ্কল্প-স্থিত।
অবশ্যই, এই ভারতে নেতৃত্বের প্রধান অর্থ অপকর্ম, এবং কৌশলের অর্থ অপকৌশল। যে ভাবে বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের অসমে সরিয়ে এনে লুকিয়ে রেখে অভ্যুত্থানের মাফিক সরকার-বদল ঘটল, তা দেখে একুশ শতকের অভ্যস্ত চোখও অসুস্থ বোধ করতে পারে। নৈতিকতার প্রশ্নে অবশ্য কাউকেই উপরে রাখা যায় না। বিজেপি ও শিবসেনা এক মুদ্রারই এ পিঠ ও পিঠ। মহা প্রতাপশালী বাল ঠাকরে ও তস্য তনয় উদ্ধব ঠাকরের মহিমাসিঞ্চিত শিবসেনা— বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডের প্রধান হোতা ও শরিক— কোনও কালেই সততা ও উদারতার প্রতিমূর্তি ছিল না, বরং বিজেপিরই তুল্য সঙ্কীর্ণ, সাম্প্রদায়িক, ক্ষমতাকেন্দ্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক এবং জনস্বার্থবিরোধী। মহারাষ্ট্রের দলত্যাগ-সংক্রান্ত মামলা এখন আদালতে, কিন্তু বিজেপির উস্কানিতে বিক্ষুব্ধ শিবসেনার চোরাগোপ্তা আক্রমণের সামনে উদ্ধববাহিনীও কিন্তু সমধিক অপকর্মলিপ্ত— সাফল্যের খতিয়ান কেবল আলাদা।
মহারাষ্ট্রের নাটকটি জমাটি ও রুদ্ধশ্বাস হলেও একে অপ্রত্যাশিত বলা কঠিন। মহা বিকাশ আঘাড়ি নামে যে আশ্চর্য যৌথ সরকার এত দিন সে রাজ্যে চলছিল, তার অভ্যন্তরে শিবসেনা, এনসিপি ও কংগ্রেস কেউই কখনও স্বস্তি বোধ করেনি। অসম্ভবের ছন্দে কাব্য রচনা হতে পারে, সরকার চালানো যায় না। শিন্ডে যখন বলেন, উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বে হাঁসজারু সরকারটি ছিল ‘আন-ন্যাচরাল’, তিনি খুব ভুল বলেননি— কেবল বলেননি যে তিনি নিজে তার ভিতরে অনবরত স্বার্থসিদ্ধির চোরাপথ খুঁজছিলেন। হিন্দুত্ব আবেগকে উস্কে শিন্ডে সেই পথ বার করে ফেললেন ঠিকই, বিজেপিও তাতে অকৃপণ সহায়তা এগিয়ে দিল— কিন্তু প্রকৃত সত্য, এমভিএ সরকারের ভিতটি প্রথম দিন থেকেই নড়বড়ে, এলোমেলো। বিজেপির কৌশল প্রথম শ্রেণির। তবে ভাগ্যও পুরোদমে তার পাশে। ভাগ্য আজকাল দুঃসাহসী অপকৌশলীরই সহায় হয়— অন্তত আজকের এই ভারতে। শিবসেনার প্রাদেশিক ভূমিকা পরিবর্তনে জাতীয় স্তরে তার অবস্থান কতটা পাল্টাবে, এটাই এখন কৌতূহলের বিষয়। তবে যা-ই ঘটুক না কেন, মহারাষ্ট্র-কাণ্ডের পর জাতীয় স্তরে বিরোধীরা আরও কয়েক দাগ হীনবল, সন্দেহ নেই। তাদের নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসের বাঁধন নেই, ঐক্যের ইশারা নেই, এবং সবচেয়ে বড় কথা, কৌশলের প্রয়োজন-বিবেচনাও নেই। এ সবের অভাবে সত্যিই বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দল নিজেকে আয়নায় দেখতে শুরু করছে প্রায় অপরাজেয় সাম্রাজ্যবাদীর মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy