বিশেষ তদন্তকারী দল (এসআইটি) জানাইয়াছে যে, লখিমপুর খেরিতে কৃষকদের উপর গাড়ি চড়াইয়া দিবার ঘটনাটি দুর্ঘটনা নহে, পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রের পুত্র আশিসের বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি ধারায় মামলা দাখিল করিবার সুপারিশ করিয়াছেন তদন্তকারীরা। এক্ষণে একটি প্রশ্ন জাগিতে বাধ্য— শীর্ষ আদালত যদি এসআইটি পুনর্গঠন না করিত, যদি উত্তরপ্রদেশ পুলিশের হাতেই তদন্তভার থাকিত, তাহা হইলেও কি এই হত্যাকাণ্ডটি ‘পূর্ব পরিকল্পিত’ হিসাবে ঘোষিত হওয়া সম্ভব ছিল? উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের রাজত্বকালকে সাক্ষী মানিতে হইলে এই প্রশ্নের একটিই উত্তর হয়— কদাচ নহে। বস্তুত, আদালত তিরস্কার না করিলে মন্ত্রী-পুত্র আদৌ গ্রেফতার হইতেন কি না, সেই বিষয়েও সন্দেহ বিস্তর। মন্ত্রী অজয় মিশ্র স্থানীয় রাজনীতিতে বাহুবলী হিসাবেই পরিচিত— এবং, এই অঞ্চলের বাহিরে তাঁহার পরিচিতি যৎসামান্য, মূলত ছেলের কুকীর্তির কারণেই এখন লোকে তাঁহাকে চেনে। সম্প্রতি সাংবাদিকদের উপর চড়াও হইয়াও তিনি খানিক খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন। পুত্রের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ উঠিবার পরও যে অজয় মিশ্র মন্ত্রিত্ব হইতে পদত্যাগ করিবেন না, তাহা বোঝা কঠিন নহে। বস্তুত, বিধানসভা নির্বাচনে পুত্রের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করিতেও তিনি যথেষ্ট সক্রিয়। কিন্তু, রাজনৈতিক মহল হইতে প্রবল দাবি উঠা সত্ত্বেও কেন প্রধানমন্ত্রী তাঁহাকে পদত্যাগ করিতে বাধ্য করিতেছেন না, সেই প্রশ্নের উত্তর নাই।
মামলাটি বিচারাধীন, এই যুক্তিতে সংসদে অজয় মিশ্রের পদত্যাগের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করিতে দেয় নাই সরকার। বিচিত্র যুক্তি, কারণ বিচারের স্বার্থেই এই আলোচনা হওয়া জরুরি ছিল। শাসক পক্ষ প্রশ্ন তুলিয়াছে, পুত্রের অপরাধে পিতাকে কি শাস্তি দেওয়া চলে? প্রশ্নটি বিচিত্রতর। তাঁহারা স্মরণ করিতে পারেন, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত শিক্ষাবিদ-সমাজকর্মীদের জামিনের বিরোধিতায় সরকারি কৌঁসুলি নিয়মিত একটি যুক্তি ব্যবহার করেন— অভিযুক্তরা প্রভাব খাটাইয়া বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করিতে পারেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পিতার প্রভাব খাটাইবার ক্ষমতা অশীতিপর পাদরি বা অশক্ত শিক্ষকের তুলনায় কম,
প্রবল ভক্তের পক্ষেও এই কথাটি বিশ্বাস করা কঠিন হইবে। বিশেষত, গত কয়েক মাসে অজয় মিশ্রের যে ভূমিকা দেখা গিয়াছে, তাহাতে ইহা বিশ্বাস করিবার কোনও কারণ নাই যে,
তিনি পুত্রকে রক্ষা করিতে ন্যায়-অন্যায় কোনও পন্থাই ব্যবহারে সংযত থাকিবেন। এবং, যত ক্ষণ অজয় মিশ্র মন্ত্রী থাকিবেন, তত ক্ষণ অবধি এই কথাটিও প্রশ্নাতীত থাকিবে যে, গুরু নানক জয়ন্তীতে প্রধানমন্ত্রীর টেলিভিশন-ভাষণটি নিতান্ত সারবত্তাহীন। কৃষক বিক্ষোভ সংক্রান্ত কোনও ঘটনাতেই তিনি আদৌ দুঃখিত নহেন। বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বজায় রাখিতেও তাঁহার আগ্রহ নাই।
প্রশ্ন উঠিবে, অজয় মিশ্র কি এমনই গুরুত্বপূর্ণ কোনও নেতা যে, তাঁহাকে বরখাস্ত করা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অসম্ভব? মিশ্রের রাজনৈতিক জীবন এই প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তর দিবে। অনুমান করা চলে, তিনি নিমিত্তমাত্র। তাঁহাকে বরখাস্ত করিবার পথে যাহা বাধা হইয়া দাঁড়াইতেছে, তাহা প্রধানমন্ত্রীর অহং। যে অহং এক বৎসর ধরিয়া কৃষি আইন প্রত্যাহারের পথেও অলঙ্ঘ্য বাধা হইয়া ছিল। শেষ অবধি তাঁহাকে বিধানসভা নির্বাচনের স্বার্থে কৃষকদের দাবি মানিতে হইয়াছে— ইহাতে তাঁহার লৌহপুরুষ ভাবমূর্তিতে ধাক্কা লাগিয়াছে বলিয়াই প্রধানমন্ত্রীর অনুমান। ফলে, বিরোধীদের দাবি মানিয়া মিশ্রকে বরখাস্ত করিতে তিনি নারাজ। তাহাতে গণতন্ত্রের ক্ষতি হইলে হউক, বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত হইলে হউক। ভারতীয় গণতন্ত্রের কী অসীম দুর্ভাগ্য যে, এক ব্যক্তিবিশেষের অহংয়ের সম্মুখে তাহাকে বারংবার মাথা নোয়াইতে হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy