Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Israel Palestine Conflict

নিষ্ক্রিয়তার ‘যুক্তি’

দিল্লির প্রতিযুক্তি: গাজ়ায় যা ঘটছে তা অবশ্যই মর্মান্তিক এবং গভীর উদ্বেগের কারণ; যুদ্ধবিরতি জরুরি, এ বিষয়েও ভারতের বিন্দুমাত্র দ্বিমত নেই; তার আপত্তির কারণ— রাষ্ট্রপুঞ্জে আনীত প্রস্তাবটির ভাষা।

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৪২
Share: Save:

ভারতের বিদেশ নীতির চালকরা প্যালেস্টাইন সঙ্কটের অভিঘাত সামলানোর কঠিন পরীক্ষায় কেমন ফল করছেন? একটি মত: গাজ়ায় ইজ়রায়েলের ভয়াবহ আক্রমণ ও অবরোধের বিরুদ্ধে ভারতের আরও ‘সুস্পষ্ট’ অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল। অন্য মত: বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে যথোপযুক্ত কূটনীতির দাবি মেনে আপন প্রতিক্রিয়ায় ভারসাম্য বজায় রাখাই সুবিবেচনার কাজ, ভারত সেটাই করেছে। প্রথম মতটিতে আবেগ প্রধান, দ্বিতীয়টিতে বাস্তববোধ। কূটনীতিতে সাধারণ ভাবে বাস্তববাদেরই জোর বেশি। তবে গত সপ্তাহান্তে এই পরীক্ষায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে আনীত প্রস্তাবটি যে দুই-তৃতীয়াংশ দেশের অনুমোদন পেয়েছে, ভারত তাদের শরিক হয়নি, ভোটদানে বিরত থেকেছে। এই সিদ্ধান্তের প্রবল সমালোচনা অপ্রত্যাশিত ছিল না। বিরোধী দল কংগ্রেস-সহ সমালোচকদের প্রধান বক্তব্য: গাজ়ায় ইজ়রায়েলের বিধ্বংসী অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করা এখন মানবতার ন্যূনতম শর্ত, রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাব সেই শর্তই পূরণ করতে চেয়েছে, অসামরিক নাগরিকদের রক্ষাকবচ দেওয়া এবং ত্রাণ-সাহায্য পাঠাতে দেওয়াও তার স্বাভাবিক অঙ্গ। এমন একটি প্রস্তাবেও ভারত সরকার ‘হ্যাঁ-ও নয়, না-ও নয়’ অবস্থান নিয়ে সেই শর্ত লঙ্ঘন করল। এই নিষ্ক্রিয়তা মোটেই নিরপেক্ষতা নয়, এ হল কার্যত আমেরিকা-ইজ়রায়েলের দলে ভিড়ে যাওয়া।

দিল্লির প্রতিযুক্তি: গাজ়ায় যা ঘটছে তা অবশ্যই মর্মান্তিক এবং গভীর উদ্বেগের কারণ; যুদ্ধবিরতি জরুরি, এ বিষয়েও ভারতের বিন্দুমাত্র দ্বিমত নেই; তার আপত্তির কারণ— রাষ্ট্রপুঞ্জে আনীত প্রস্তাবটির ভাষা। বস্তুত, নীরবতা। ৭ অক্টোবর হামাস ইজ়রায়েলে যে ‘সন্ত্রাসী’ আক্রমণ চালিয়েছিল, প্রস্তাবে তার উল্লেখ নেই। এই নীরবতা কার্যত ওই সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। অর্থাৎ, প্রস্তাবটিতে (‘এক ধরন’-এর সন্ত্রাসের প্রতি) পক্ষপাতিত্ব আছে। ভারত এই অন্যায় পক্ষপাতিত্বে শামিল হবে না বলেই নিষ্ক্রিয় থেকেছে। এই বক্তব্যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় আছে, আছে যুক্তিও— সন্ত্রাসের জাতি-বিচার সত্যই মেনে নেওয়া যায় না। মনে রাখতে হবে, কানাডা রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাবটিতে হামাসের আক্রমণের নিন্দাবাদ যোগ করতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই সংশোধনী প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। স্পষ্টতই, হামাসকে ‘আড়াল’ করার পরিকল্পনাতেও অনেক দেশ শামিল। এই পক্ষপাতিত্বের প্রতিবাদ যুক্তিসঙ্গত বইকি। কিন্তু প্রতিবাদ জানানোর পরেও প্রস্তাবটি সমর্থন করা যেত, যেমন পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলার পরেও ফ্রান্স যুদ্ধবিরতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রস্তাবের পক্ষেই ভোট দিয়েছে। অতএব সংশয় থেকে যায়, ভারত সরকার জলে নেমে বেণি না ভেজানোর কৌশল হিসাবেই প্রস্তাবের দোষত্রুটিকে ব্যবহার করল না তো?

এমন সংশয়ের কারণ যে ভবিষ্যতেও ঘটবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। প্যালেস্টাইন প্রশ্নে ভারতকে ক্ষুরধার পথের উপর দিয়েই হাঁটতে হবে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিদেশ নীতি অনেক দিন অবধি স্বল্পবুদ্ধি, আড়ম্বর এবং হঠকারিতার ত্র্যহস্পর্শেই বেসামাল ছিল। সাম্প্রতিক কালে, বিশেষত রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বৈরথের কঠিন অভিঘাতের মোকাবিলায় অন্য ধরনের আচরণ দেখা গিয়েছে, যে আচরণে বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার ছাপ আছে। পশ্চিম দুনিয়ার ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলির সমালোচনা এবং চাপ সত্ত্বেও ভারত মস্কোর সমালোচনায় সংযত থেকেছে। এই সংযমের কল্যাণেই কূটনৈতিক ভারসাম্যের খেলায় এখন ভারতের গুরুত্ব অনেকখানি, পশ্চিমি দেশগুলিও তা স্বীকার করে। প্যালেস্টাইন প্রশ্ন আরও অনেক বেশি জটিল। কিন্তু এই প্রশ্নেও শেষ বিচারে কূটনীতির চালিকা শক্তি হওয়া উচিত জাতীয় স্বার্থ। স্লোগান-সর্বস্ব বায়বীয় আবেগ নয়, দলীয় রাজনীতির ক্ষুদ্র স্বার্থও নয়, বিশ্ব রাজনীতির বাস্তব পরিসরে ভারতের ভূমিকাকে জোরদার করার লক্ষ্যই কূটনীতির সামনে যথার্থ পাখির চোখ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy