রাষ্ট্রপুঞ্জের মতদানে ভারত যখন নিজেকে বিরত রাখিল, আমেরিকা ও রাশিয়া বার্তা পড়িয়া লইতে ভুল করে নাই। আমেরিকার অন্যতম প্রধান সংবাদপত্র, ভারতের বর্তমান সরকারের প্রতি যাহার অপ্রীতি কোনও গোপন কথা নহে— স্পষ্টাক্ষরে ক্ষোভ প্রকাশ করিল। বলিল, ইহাকে ‘সরিয়া থাকা’ বলা মুশকিল, ইহা ‘পক্ষ লওয়া’, অবশ্যই রাশিয়ার পক্ষ। মন্তব্য করিল, জানা আছে যে রাশিয়া-ভারত মৈত্রীর ইতিহাস দীর্ঘ, এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও ২০১৪ সালে ক্ষমতারোহণের পর প্রায় কুড়ি বার রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মিলিত হইয়াছেন। দুই দেশই ‘পেশিশক্তির জাতীয়তাবাদ’ দিয়া রাষ্ট্রচালনায় পোক্ত হইয়াছে। ইত্যাদি। বিপরীত দিকে, রাশিয়ার হর্ষোৎফুল্লতাও চাপা রহিল না। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের তরফে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের নিন্দাপ্রস্তাব পাশ হওয়া-না হওয়ায় মস্কোর বিশেষ কিছু আসিয়া না গেলেও ভারতের এই কূটনৈতিক পদক্ষেপ স্বভাবতই রাশিয়ার বড় জয়। হাজার হউক, ১৫ সদস্য-সম্বলিত নিরাপত্তা পরিষদে চিন আর সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে ভারতের ভোটটিকেও নিষ্ক্রিয় করিয়া দিবার কৃতিত্ব কম নহে— বিশেষ করিয়া যখন বাহিরে পাকিস্তানও এই একই রাস্তার পথিক। উষ্ণায়িত ঠান্ডা যুদ্ধের দুই মেরুর প্রতিক্রিয়া কী রকম দাঁড়াইবে, ভারতের অজানা ছিল না। তাহা সত্ত্বেও স্বার্থরক্ষার যে জটিল হিসাব কষিয়া দিল্লি এই স্থানে পৌঁছাইল, তাহাকে কূটনীতি হিসাবেই দেখিতে হইবে— অন্য কিছু নহে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অবস্থান না লইবার ছলেও অবস্থান লওয়া মর্মে যে অভিযোগ, তাহা অর্থহীন। প্রথমত কূটনীতিতে নিজ দেশের স্বার্থভাবনার ছায়াপাত অতি স্বাভাবিক ঘটনা, এবং দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনেও পক্ষাবলম্বন থাকিত না, এই দাবি প্রগাঢ় নেহরুপন্থীও করিবেন না।
সুতরাং প্রকৃত প্রশ্নটি মানবাধিকারের। পরিস্থিতি অতীব উদ্বেগজনক। সন্দেহ নাই যে, রাশিয়াই আগ্রাসনকারী। ইউক্রেনে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মস্কোর বিরক্তি উদ্রেকের শত কারণ থাকিলেও এই মাপের আগ্রাসন সম্পূর্ণত অনৈতিক, অমানবিক— মুক্তকণ্ঠে নিন্দাযোগ্য। একবিংশ শতকের পরমাণু-অস্ত্র অধ্যুষিত সভ্য পৃথিবীর দস্তুর এমন হইতেই পারে না। এবং, আগে অমুক দেশও অমুক স্থানে এমন করিয়াছে, এ-হেন ছেঁদো যুক্তিও চলিতে পারে না। তাহারাও তখন অন্যায় করিয়াছিল, রাশিয়াও এখন করিতেছে। লক্ষণীয়, ভোটদানে বিরত থাকিবার আগে এবং পরে দিল্লি ধারাবাহিক ভাবে রাশিয়ার কাছে এই আক্রমণ প্রত্যাহার করিবার এবং অস্ত্র সংবরণ করিবার অনুরোধ-উপরোধ বারংবার করিয়াছে। সুতরাং কূটনীতির একাধিক তল হিসাবে পদক্ষেপগুলিকে দেখা সঙ্গত। ইহাও সত্য যে, মধ্যস্থতার পরিসরটি ছাড়িয়া দিলে চলিবে না। বাস্তবিক সেই পরিসরটিই এখন কূটনীতির দিক দিয়া সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিতে পারে।
অবশ্যই এই স্থলে ভারত একটি প্রধান ভূমিকা পালন করিতে পারে। ভুলিলে চলিবে না যে, শতক পাল্টাইছে, দিনকালও। ভারতের ‘স্বার্থ’ এখন আমেরিকার বন্ধুত্বেও নিতান্ত রকম প্রবিষ্ট। এক দিকে ইসলামি মৌলবাদ এবং অন্য দিকে চিনা আগ্রাসনবাদ লইয়া ভারতের পক্ষে আমেরিকাকে চটানো কোনও কাজের কথা হইতে পারে না। সুতরাং, এই বিরাট সঙ্কটমুহূর্তে মস্কোর সহিত কোনও একটি কথোপকথন-তল যদি তৃতীয় পক্ষ হিসাবে দিল্লি খুলিতে পারে, সকলেরই স্বার্থ তাহাতে রক্ষিত হইবার সম্ভাবনা— আমেরিকা এবং নেটোরও। কিন্তু তাহার জন্য বুদ্ধিমত্তা ও সুযোগসন্ধান জরুরি, ভারতীয় কূটনীতিক মহলে যাহার বিশেষ অভাব একটি ঐতিহাসিক বাস্তব! যে ‘স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি’র জন্য দিল্লির ভূমিকায় মস্কো আপাতত প্রফুল্ল, সেই দৃষ্টিটি ইউক্রেন সঙ্কটে অতঃপর কতখানি ব্যবহার করা যাইবে, ইহাই পরবর্তী প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy