প্রতীকী ছবি।
ভাষার প্রয়োজন মানুষেরও, রাষ্ট্রেরও। কাহারও ভাব প্রকাশের জন্য, কাহারও কাজ চালাইবার জন্য। উপমহাদেশের ত্রিধাবিভক্তির পর ভারত নামক যে আধুনিক প্রজাতন্ত্রের জন্ম হইল, তাহার সূচনালগ্নেই প্রশ্ন উঠিল: কী ভাষায় কাজ চলিবে? প্রশ্নটি উঠিল, কেননা ইতিপূর্বে কোনও এক নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলিত না এই দেশের জনগণ। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের সংবিধানপ্রণেতারা বহুভাষিকতার সেই প্রাণটি বুঝিয়াছিলেন। সংবিধানের দ্বাদশ খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ের ‘ল্যাঙ্গোয়েজেস অব দি ইউনিয়ন’ অংশে ৩৪৩ হইতে ৩৫১ ধারার ভিতর ভারতীয় ভাষাসমূহের ক্রম নির্ধারিত হইল। প্রশাসনিক ভাষা বা ‘অফিশিয়াল ল্যাঙ্গোয়েজ’ হইল হিন্দি ও ইংরেজি, রাজ্য স্তরে সরকারি ভাষা হইল বাংলা, মরাঠি, তামিল, অসমিয়ার ন্যায় আঞ্চলিক ভাষাসমূহ, মানুষের সহিত যোগাযোগের নিমিত্ত ‘গণতন্ত্র’-এর ভাষা হইল আরও বহু। পৃথক ভাবে, সংবিধানের অষ্টম তফসিলে ৩৪৪ (১) এবং ৩৫১ ধারায় আঠারোটি ভাষাকে (অধুনা বাইশ) জাতীয় ভাষা বা ‘ন্যাশনাল ল্যাঙ্গোয়েজ’ বলিয়া স্বীকার করা হইল। উল্লিখিত হইল উর্দু, সিন্ধি, সংস্কৃত, ওড়িয়া, কাশ্মীরি, হিন্দি, বাংলা ইত্যাদির সমগুরুত্বের কথা। বহু ভাষার সহাবস্থান সমাজে ভাষাগুলির ভূমিকা, শক্তি ও মর্যাদার তুল্যমূল্য বিচারসভা বসাইয়া থাকে, কিন্তু নীতিগত ভাবে রাষ্ট্রের পক্ষে এক ভাষা অপেক্ষা অপরের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করা বিধেয় নহে। সুতরাং, সুষ্ঠু ভাবে দেশ চালাইবার স্বার্থে সংবিধানে প্রতিটি ভাষার ভূমিকা পরিকল্পনা বা ‘স্টেটাস প্ল্যানিং’-এর বিস্তর আয়োজন।
তবে, ভাষা রাষ্ট্রের নির্দেশ শোনে না। তাহা আক্ষরিক অর্থেই, আপন বেগে পাগলপারা। ভাষা সম্মুখে বাধা আসিলে ধাক্কা দেয়, বাধা কঠিন হইলে রাস্তা বানাইয়া লয়। তাহার এক পাড় ভাঙে, আর এক পাড় গড়ে। এক পাড়ে যখন ধ্বংসের ক্রন্দন, অপর পাড়ে প্রাণের স্পন্দন। অতএব রাষ্ট্র যতই সুষ্ঠু আয়োজনের ব্যবস্থা করুক, মর্যাদা বা ‘স্টেটাস’-এর প্রশ্নে ভাষার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার পার্থক্য ঘটিয়াই যায়। আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী জন গাম্পার্জ় প্রশাসনিক ক্রমবিন্যাসের বিপরীতে বহুভাষার সামাজিক শ্রেণিবিভাগ করিয়াছিলেন, যেখানে স্বল্প হইতে অধিক জটিল গোষ্ঠীর অভিমুখে একটি ক্রম নির্মিত হইয়াছিল। তিনি দেখাইয়াছিলেন, বৃত্তিমূলক জনজাতি সমাজ অপেক্ষা অনেক বেশি জটিল অর্থনৈতিক স্তর-বিভাজিত সমাজ। তাই আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রে বহু ভাষা পাশাপাশি বাস করিলেও তাহাদের অবস্থান অনুভূমিক নহে— উল্লম্ব। বহুভাষিক সমাজ বহুতল গৃহের তুল্য, যাহার এক এক তলে এক এক ভাষার বাস। উচ্চ-মধ্য-নিম্নরূপের হিসাবেই ভাষাগুলিকে চিহ্নিত করে সমাজ, প্রশাসনের ভাষা পরিকল্পনাও সেই হিসাবে। যাহা সর্বভারতীয় সরকারি ভাষার স্বীকৃতি পাইল, তাহা একটি রাজ্য ভাষা অপেক্ষা এক তল উপরে অবস্থান করিল, আরও নিম্নে রহিল অষ্টম তফসিলে ঠাঁই না পাওয়া আঞ্চলিক ভাষা।
সমস্যা হইল, বৃহৎ কখনও ক্ষুদ্রকে গিলিয়া খাইতে চাহে। সমাজের বড় ছোটকে অধিকার করিবার আকাঙ্ক্ষা করে। বহুভাষিক সমাজে এই আগ্রাসন কেবল সত্য নহে, প্রধান চরিত্র। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, নির্দিষ্ট সময়বিন্দুতে নির্দিষ্ট ভাষার বাস্তব ভূমিকাই সমাজে তাহার মর্যাদা ও অন্তর্গত সমৃদ্ধি তৈরি করে; বাস্তব ক্ষেত্রে যে হেতু সকলের ক্ষমতা সমান নহে, সকল ভাষার মর্যাদাও তাই সমান হয় না। সুতরাং, সমাজে বৃহত্তর ভূমিকা পালন করিবার সূত্রে কোনও ভাষা যদি কম ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভাষাসমূহের অঞ্চলে থাবা বসায়, তদপেক্ষা দুর্ভাগ্যের কিছু নাই। ভারতে এই রূপ একচেটিয়া আগ্রাসনের অভিযোগ হিন্দির বিরুদ্ধে বারংবার উঠে, ইদানীং ঘন ঘন শোনা যাইতেছে। সমাজের নিরিখে তাহার অধিক ক্ষমতা বাস্তব, কিন্তু যে খাঁটি ইচ্ছা ও পরিশ্রমে সংবিধানে বহু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহার অসম্মান। পুষ্করিণীতে বড় মাছ ছোটকে ভক্ষণ করিবার পরিস্থিতিকে মাৎস্যন্যায় বলে; ইহার অর্থ অরাজকতা— ক্ষমতার বলে কাহাকেও অধিকার করা যায়, অর্জন করা যায় না, উহাতে বৈচিত্রের সমূহ ক্ষতি। জোর যাহার মুলুক তাহার অরণ্যের নিয়ম, সভ্য সমাজের নহে। ভুলিলে চলিবে না, ঊনসত্তর বৎসর পূর্বে বাংলা ভাষার প্রতিরোধই প্রশাসনিক উর্দুর একচেটিয়া আগ্রাসন রুখিয়াছিল। মাতৃভাষা দিবসে তাই আবারও ক্ষমতার ইতিহাসই মনে করিবার, ফিরিয়া পড়িবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy