Advertisement
E-Paper

স্বস্তি, আপাতত

গত দু’বছরে দেশের নানা অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মসজিদ বা দরগার অতীত যাচাইয়ের আবেদন জানিয়ে বিভিন্ন আদালতে মামলা হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে প্রত্ন-সমীক্ষার নির্দেশও দিয়েছে আদালত।

শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৩৮
Share
Save

দাবানল যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আপাতত তার বন্দোবস্ত হয়েছে। কম কথা নয়। ধর্মস্থানের চরিত্র বদল নিষিদ্ধ করে ১৯৯১ সালে প্রণীত আইনটি সংবিধানসম্মত কি না, সেই প্রশ্ন সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। প্রধান বিচারপতি-সহ তিন বিচারকের বেঞ্চ জানিয়েছে, এই অবস্থায় কোনও আদালতে ধর্মীয় উপাসনাস্থলের চরিত্র বদল সংক্রান্ত নতুন কোনও মামলা গ্রাহ্য হবে না, যে-সব মামলা চলছে সেগুলির ক্ষেত্রেও কোনও কার্যকর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা যাবে না, বিশেষত ধর্মস্থানের চরিত্র বিচারের জন্য কোনও সমীক্ষার নির্দেশ দেওয়া চলবে না। গত দু’বছরে দেশের নানা অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মসজিদ বা দরগার অতীত যাচাইয়ের আবেদন জানিয়ে বিভিন্ন আদালতে মামলা হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে প্রত্ন-সমীক্ষার নির্দেশও দিয়েছে আদালত। এই সব মামলা এবং নির্দেশকে কেন্দ্র করে অনিবার্য উদ্বেগ ও অশান্তি বেড়ে চলেছে। গত মাসে উত্তরপ্রদেশের সম্ভলে এমন এক মামলার সঙ্গে সঙ্গে সমীক্ষার নির্দেশ এবং তাকে কেন্দ্র করে প্রাণঘাতী হিংসার কাহিনি সর্বজনবিদিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তটি আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রশমিত করতে পারে। আপাতত।

তবে আশঙ্কা দূর হয়েছে, এমন কথা বলার উপায় নেই। ধর্মস্থানের ইতিহাস খুঁড়ে দেখার যে প্রবণতা চতুর্দিকে অশান্তি, উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, সেটি ষোলো আনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমির ইতিহাস সেই রাজনীতির, আক্ষরিক অর্থেই, যুগান্তকারী অধ্যায়। সহিষ্ণুতা, সহাবস্থান এবং যুক্তসাধনার ভিত্তিতে গড়ে তোলা গণতন্ত্রের ধারণাকে সরাসরি অস্বীকার করে ধর্মাশ্রিত সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির আগুনে সংখ্যাগুরুবাদী রাজনীতির হাতিয়ার তৈরি করার যে পথ প্রায় চার দশক আগে উন্মোচিত হয়েছিল, ভারত সেই পথে বহু দূর অবধি এগিয়ে গিয়েছে। পিছন দিকে এগিয়ে গিয়েছে বলাই যুক্তিযুক্ত। সংখ্যালঘুর উপাসনাস্থল খুঁড়ে খুঁড়ে সংখ্যাগুরুর উপাসনাস্থলের চিহ্ন ‘আবিষ্কার’ করার যে ধুন্ধুমার তৎপরতা এখন দেখা যাচ্ছে, সেই ভয়ঙ্কর অভিযানের মধ্যে কোনও যথার্থ ধার্মিকতা নেই, নেই ইতিহাস-চর্চার কিছুমাত্র আকাঙ্ক্ষা, এ কেবল ‘হিন্দু ভোট’ এককাট্টা করার ষড়যন্ত্র। অযোধ্যা নামক ‘ঝাঁকি’র ফসল গোলাঘরে উঠেছে, এখন কাশী মথুরা-সহ ‘বাকি’ বিষবৃক্ষগুলির ফল আহরণের পালা।

১৯৯১ সালের আইনটি ছিল এই বিষময় সম্ভাবনা প্রতিরোধের একটি প্রকরণ। নতুন করে যেন আর কোনও বাবরি মসজিদ কাহিনির পুনরাবৃত্তি না হয়, সেই উদ্দেশ্যেই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার এই আয়োজন হয়েছিল সে-দিন। সেই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বিষয়ে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত শেষ অবধি কোন সিদ্ধান্ত স্থির করবেন, তা অবশ্যই তাঁদের বিচার্য। কিন্তু সেই আইনি প্রশ্নের বাইরে, সুস্থ স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানের জায়গা থেকে, একটি নিতান্ত সহজ প্রশ্ন মনে রাখা আজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে, শতবার্ষিকী উদ্‌যাপনের কথা হাওয়ায় ভাসছে। এমন একটি দেশের নাগরিকরা সমবেত ভাবে, জাতি ধর্ম বর্ণ ইত্যাদি যাবতীয় সঙ্কীর্ণ পরিচয় নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন, না পিছন দিকে মুখ ফিরিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি এবং ভাঙচুরের নব নব ধ্বংসকাণ্ডে মাতবেন? বহু কাল ধরে বহু ধর্ম-সংস্কৃতির টানাপড়েনে ভারততীর্থের সৃষ্টি, এ দেশে মাটি খুঁড়ে ‘আদি অতীত’কে উদ্ধার করতে গেলে শেষ অবধি প্রস্তরযুগেই ফিরে যেতে হবে। সেটাই কি বিশ্বগুরুর ভবিষ্যৎ? ১৯৯১ সালের আইনটি সম্পর্কে সরকারের অবস্থান জানতে চেয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদবর্গ তথা তাঁদের পশ্চাদ্‌বর্তী নাগপুরের চিন্তানায়করা দাবানলের আগুনে ক্ষমতার রুটি সেঁকার তাড়নায় পিছন দিকেই এগিয়ে চলবেন কি না, দেখা যাক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Constitution Religious Places History Supreme Court of India Constitution of India

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}