পরীক্ষায় উত্তর করতে না পেরে সাদা খাতা জমা দেওয়ার নজির বিরল নয়। আবার ঠিক উত্তরটি জানা না-থাকায় পাতা জুড়ে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্প ফাঁদার নমুনাও বিস্তর। শিক্ষকদের অভিজ্ঞতার ঝুলিটি উপুড় করলে তা থেকে পরীক্ষার খাতাসংক্রান্ত নানাবিধ মণিমুক্তোর সন্ধান মেলে। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই বারের মাধ্যমিকের খাতার যেন কোনও মিল নেই। তাতে শুধুমাত্র পরীক্ষার্থীর অ-প্রস্তুতিটিই চোখে পড়েনি, বরং বেশ কিছু উত্তরপত্রে কটুকথার বন্যা দেখে স্তম্ভিত শিক্ষক থেকে মনোবিদরা। অপ্রাসঙ্গিক, অর্থহীন সেই সব কটুকথার উদ্দেশ্য কোনও ব্যক্তিবিশেষ বা সমাজ নয়, ভিতরের জমা নিষ্ফল ক্রোধটুকু যেন তারা উগরে দিয়েছে উত্তরপত্রে।
এই ঘটনা উদ্বেগের। অতিমারির কারণে দীর্ঘকাল স্কুলে পঠনপাঠন বন্ধ থাকায় একশ্রেণির পড়ুয়া উপযুক্ত শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পরিবারের আর্থিক, পারিবারিক চাপে হয়তো পরীক্ষার উপযুক্ত প্রস্তুতিটিও নিতে পারেনি। এমতাবস্থায় হতাশা, ক্ষোভ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশের ধরনটি এমন হল কেন, তা নিয়ে আরও গভীর চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। কারণ, তা এক বৃহত্তর সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে আঙুল তোলে। ছোটরা ভাষাজ্ঞান নিয়ে জন্মায় না। তারা যা দেখে, শোনে, তা-ই শেখে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সমাজে কুকথার স্রোত সাম্প্রতিক কালে বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পথে, পরিবহণে সর্বত্র তুচ্ছ কারণে গালিগালাজ, আপত্তিকর ভাষা প্রয়োগ যেন সামাজিক রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বোপরি, রোগের প্রাদুর্ভাব, আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং লকডাউনে দীর্ঘ বদ্ধ জীবন মানুষকে যেন আরও অনেক বেশি অসংযমী, অসহিষ্ণু করে তুলেছে। ফলে বাড়িতেও ছোটদের সামনে কথায়, ব্যবহারে আত্মসংযমের বালাই থাকছে না। অনুকরণপ্রিয় ছোটরা যদি এই গালাগালির সংস্কৃতিকেই স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
বঙ্গীয় রাজনীতিও সেই সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ক্রমাগত প্রশ্রয় দিয়ে চলছে। বস্তুত, সমাজে কুকথার বাড়বাড়ন্তের জন্য রাজনৈতিক নেতারা অনেকাংশে দায়ী। জননেতাদের মার্জিত, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি আজ উধাও। বিরোধী দলের মতকে অশ্রদ্ধা, প্রকাশ্যে বিরোধীদের কুৎসিত ভাষায় আক্রমণই এখন রাজনীতির বিশেষত্ব। নির্বাচনী ভাষণে, বিতর্ক সভায় অসংলগ্ন, অর্থহীন, কুরুচিকর শব্দস্রোত দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যম, এবং সমাজমাধ্যমের হাত ধরে অগণিত জনতার কাছে মুহূর্তে পৌঁছচ্ছে। প্রসঙ্গত, কুকথার সংস্কৃতির জন্ম যদি রাজনীতির হাতে হয়, তবে তাকে পরিপুষ্ট করেছে নিঃসন্দেহে সমাজমাধ্যমের আবির্ভাব। গৃহস্থের অন্দরমহলে সমাজমাধ্যমের প্রবেশ এবং কুকথার সংস্কৃতি তুঙ্গে ওঠার মধ্যের যোগসূত্রটি এখন স্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত। ছোটরা যদি নিয়মিত সমাজমাধ্যমের পর্দায় দেখে ছাত্রনেতা কলেজের অধ্যক্ষকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করছে, চড়থাপ্পড় মারছে, অপছন্দের লেখা, সিনেমার প্রতিক্রিয়ায় লেখক, পরিচালককে কদর্য ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে, তা হলে সে কী শিখবে? যে অভিভাবক সমাজ এই ঘটনা দেখে বা পড়ে বা শুনে অবাক হয়েছেন, দুঃখ পেয়েছেন, তাঁদের সকলেরই জানা দরকার— আপনি আচরি সংস্কৃতি পরেরে শেখানো দরকার।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy