Advertisement
২৪ অক্টোবর ২০২৪
True Freedom

‘প্রকৃত স্বাধীনতা’

জাতি-রাষ্ট্র যে ন্যায্যতার সন্ধান করবে, এই ‘অপর’ তার অন্তর্ভুক্ত হবেন না। অতএব, ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ও যে সবার কাছে সমান ইতিবাচক, সে দাবি করার উপায় নেই।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০২৪ ০৮:২৩
Share: Save:

কেবল ঔপনিবেশিক শাসন বিদায় নিয়ে দেশি মানুষের হাতে শাসনভার এলেই কি তাকে প্রকৃত স্বাধীনতা বলা চলে? এ প্রশ্নের বয়স ঔপনিবেশিক বিশ্বে অন্তত একশো বছর। বিভিন্ন মুহূর্তে ভারত এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৫ অবধি বামপন্থীদের চালু স্লোগান ছিল ‘ইয়ে আজ়াদি ঝুটা হ্যায়’। ধারণাটি অবশ্য তাঁদের উদ্ভাবন নয়— এরও অন্তত দু’দশক আগে স্বয়ং জওহরলাল নেহরু বিভিন্ন পরিসরে ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’র (বনাম ‘নকল স্বাধীনতা’) কথা বলতেন। এই মুহূর্তেও বিশ্বের একাধিক প্রান্তে ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ নিয়ে তর্ক চলছে। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সেই তর্কের প্রত্যক্ষ বিষয়বস্তু পৃথক— এমনকি, এটাও সম্ভব যে, কোনও একটি সময়বিন্দুতে কোনও একটি রাজনৈতিক প্রতর্ক যাকে স্বাধীনতার নকল রূপ হিসাবে চিহ্নিত করেছে, অন্য কোনও সময়বিন্দুতে অন্য কোনও প্রতর্ক হয়তো তাকেই কাঙ্ক্ষিত প্রকৃত স্বাধীনতা জ্ঞান করেছে। কিন্তু, সেই বিরোধগুলিকে সরিয়ে রাখলে প্রতিটি ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’-অন্বেষণের একটি অভিন্ন চরিত্র আছে— প্রতি ক্ষেত্রেই খোঁজ চলে এমন কোনও নীতির, যা সেই জাতি-রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি ন্যায়বিধান করবে। কোনও রাষ্ট্রের নাগরিক হলেই যে কেউ সেই জাতি-রাষ্ট্রেরও নাগরিক হবেন, প্রত্যেকেই যে সেই বণ্টিত ন্যায়ের প্রাপক হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই— যে জাতি সেই রাষ্ট্রটি কল্পনা করছে, তার বিচারে যাঁরা ‘অপর’, তাঁদের ভৌগোলিক নাগরিকত্ব থাকলেও জাতি-রাষ্ট্র তাঁদের নাগরিক বলে স্বীকার করবে না। অতএব, এই জাতি-রাষ্ট্র যে ন্যায্যতার সন্ধান করবে, এই ‘অপর’ তার অন্তর্ভুক্ত হবেন না। অতএব, ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ও যে সবার কাছে সমান ইতিবাচক, সে দাবি করার উপায় নেই।

‘প্রকৃত স্বাধীনতা’র দাবির মধ্যে কী কী নিহিত থাকতে পারে, তা রাজনৈতিক কল্পনার বিষয়। কোনও কল্পনায় সেই স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নাগরিকের বিবিধ অধিকার— মত প্রকাশের; নিজের পছন্দের ধর্ম অনুশীলনের; স্বেচ্ছা জীবনযাপনের। আবার, কোনও রাজনৈতিক কল্পনা বলতে পারে যে, একটি নির্দিষ্ট ধর্মের অনুশাসন মেনে রাষ্ট্রীয়, নাগরিক ও ব্যক্তিগত জীবনযাপন করতে পারাই স্বাধীনতা। কেউ বলতে পারেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবাধ ব্যবহারের মাধ্যমে যথেচ্ছ মুনাফা অর্জন করতে পারার অধিকারই স্বাধীনতা; কারও কাছে আবার স্বাধীনতার অর্থ অর্থনৈতিক সাম্য। ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’র প্রশ্নটি কেন সর্বদাই রাজনৈতিক, এবং রাজনীতির প্রয়োজনে প্রশ্নটি কেন গুরুতর অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং হয়, তা বোঝা সম্ভব— ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে তো বটেই, দেশীয় শাসনেও এক দলের অবস্থানের বিরুদ্ধে অন্য জাতিসত্তার দাবি পেশ করার আয়ুধ হয়েছে প্রকৃত স্বাধীনতার দাবি। সে কারণেই, ভারতে গৈরিক অতিজাতীয়তাবাদী রাজনীতির সমর্থকদের একাংশের মনে হয়েছিল, ২০১৪ সালেই বুঝি স্বাধীনতা এল! কারণ উদার, বহুত্ববাদী ভারত তাঁদের জাতিকল্পনার সঙ্গে খাপ খেত না। এই মুহূর্তে অন্যত্র যে ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ অর্জনের জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, সেখানেও বিষয়টি একই রকম।

এ কথাটি স্বীকার না করলে অন্যায় হবে যে, গৈরিক অতিজাতীয়তাবাদীদের বিবিধ আক্রমণ সত্ত্বেও ভারত নামক ধারণাটি এখনও বহুলাংশে অক্ষত আছে। তার পিছনে যে জাতিকল্পনাটির গুরুত্ব সর্বাধিক, সেই কল্পনায় জাতি কোনও গোষ্ঠী-পরিচিতির উপরে নির্ভরশীল নয়— কারও ধর্ম, বর্ণ, ভাষা বা লিঙ্গ তাঁকে সেই জাতির অংশীদার হতে বাধা দেয়নি। সেই জাতিকল্পনাটি ছিল একটি ‘কৃত্রিম’ পরিচিতির উপরে নির্ভরশীল— উন্নয়নের অংশীদারির মাধ্যমে নির্মিত জাতিসত্তা। রাষ্ট্র স্বীকার করেছিল নাগরিকত্বের উদারবাদী দাবি— আইন এবং রাষ্ট্রের চোখে সমানাধিকার; অন্য দিকে, উন্নয়নের সুফল বণ্টনের পথ হিসাবে ভাবা হয়েছিল সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার কথাও। সে জাতি-রাষ্ট্রকল্পনা তার ঘোষিত লক্ষ্য থেকে কতখানি বিচ্যুত হয়েছিল, অথবা একটি কৃত্রিম জাতিকল্পনাকে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করার ফলে প্রকৃত খণ্ডপরিচয়ভিত্তিক জাতিসত্তার সঙ্গে তার বিরোধ কী ধরনের বিভাজিকা তৈরি করেছিল, সেই প্রশ্নগুলি কোনও অর্থেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু, খণ্ডজাতীয়তার স্রোত রোধ করা কত জরুরি, ঘরে-বাইরে যখন নিরন্তর তার প্রমাণ মিলছিল, তেমন সময়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের সূচনালগ্নের উদ্‌যাপনের দিনটির প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে ভারত নামক ধারণাটির নির্মাণের কল্পনাকৌশলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণ রয়েছে বইকি।

অন্য বিষয়গুলি:

independence day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE