আমেরিকার জনপ্রিয় গায়িকা বিলি আইলিশ ক্ষমা চাহিয়াছেন। উনিশ বৎসর বয়সি এই শিল্পীর একটি ভিডিয়ো-চিত্র সম্প্রতি সমাজমাধ্যমে বহুলপ্রচারিত ও বহুনিন্দিত হয়। নিন্দার কারণ, সেখানে তিনি এশিয়ান বংশোদ্ভূতদের প্রতি অমর্যাদাসূচক একটি শব্দ উচ্চারণ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের বাচনভঙ্গি নকল করিয়া কিছু উক্তিও করিয়াছিলেন। পাঁচ-ছয় বৎসর পূর্বের ভিডিয়ো-চিত্রটি প্রচারে আসিবার সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ার রীতি অনুসারে বিদ্যুতের বেগে ছড়াইয়া পড়ে এবং সেই রীতি অনুসারেই সমান বেগে ছড়াইয়া পড়ে তাঁহার ‘জাতিবিদ্বেষী’ আচরণের নিন্দা, যে নিন্দার ভাষাও বহু ক্ষেত্রেই বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। এই শোরগোলের প্রতিক্রিয়ায় গায়িকা সমাজমাধ্যমেই ক্ষমা চাহিয়াছেন। তাঁহার বক্তব্য: ওই ঘটনাটি যে সময়ের, তখন তিনি সংশ্লিষ্ট শব্দটির কদর্থ সম্পর্কে আদৌ অবহিত ছিলেন না, উচ্চারণভঙ্গি নকল করিবার মধ্যে নিহিত জাতিবিদ্বেষ সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন না। আপন কৃতকর্মের অর্থ বুঝিতে পারিয়া তিনি এখন যারপরনাই লজ্জিত এবং মার্জনাপ্রার্থী। আশা করা যায়, এই দ্ব্যর্থহীন স্বীকারোক্তি এবং আত্মসমালোচনার পরে নিন্দাবাদ প্রশমিত হইবে, নিন্দাবাদীরা অন্য নিশানা খুঁজিবেন। তবে, প্রশ্ন থাকিয়াই যায়— বিলি আইলিশের বয়স বেশি হইলে তিনি রেহাই পাইতেন কি? অথচ, কোন কথা বা কোন আচরণ কখন অপরের প্রতি অমর্যাদার সূচক হইয়া দাঁড়াইতেছে, তাহা কি প্রাপ্তবয়স্করাও সর্বদা নিশ্চিত করিয়া জানেন?
এই সূত্রেই প্রশ্ন উঠিতে পারে, ভাষা ও আচরণকে ‘যথাযথ’ রাখিবার দাবি কি অধুনা প্রায়শই আতিশয্যের পর্যায়ে চলিয়া যাইতেছে? সামাজিক পরিসরে কী বলা যায়, কী বলা যায় না, তাহার সীমারেখা কি এক ধরনের শুচিবায়ুর শিকার হইতেছে? বিশেষত, বিভিন্ন দিক হইতে যাঁহারা সামাজিক ভাবে দুর্বল, সংখ্যালঘু, প্রান্তিক, তাঁহাদের প্রতি অমর্যাদার অভিযোগ তুলিয়া অনেক সময়েই কি এক ধরনের অসহিষ্ণুতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হইতেছে? প্রশ্নগুলি জটিল। ভাষায় ও ভঙ্গিতে অপরের মর্যাদাহানির বহু উপকরণ হাজির থাকে, কখনও প্রকট ভাবে, কখনও প্রচ্ছন্ন ভাবে। পশ্চিম দুনিয়ায়, বিশেষত আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এমন বহু অমর্যাদার নিশানা হইয়াছেন, আজও তাহার অবসান ঘটে নাই। তাহার প্রতিক্রিয়াতেই ভাষাকে ‘পরিস্রুত’ করিবার দাবি প্রবল হইয়াছে। এমন অমর্যাদার নিদর্শন এই দেশেও বিস্তর। যেমন, উচ্চারণ নকল করিবার প্রসঙ্গটি বাংলার সামাজিক ইতিহাসে অতিপরিচিত। এক কালে পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণ নকল করিয়া মানুষকে বিব্রত, বিরক্ত, এমনকি লাঞ্ছিত করিবার বহু ঘটনা এই সমাজে ঘটিত। সেই আচরণ নির্দ্বিধায় নিন্দনীয়। কিন্তু এই দৃষ্টান্তটিই আবার বলিয়া দেয়, সমাজ বহু ক্ষেত্রেই আপন শক্তিতে এই ধরনের অবাঞ্ছিত আচরণ হইতে নিজেকে মুক্ত করে বা তাহাকে আত্মস্থ করিয়া লয়। পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণ লইয়া ব্যঙ্গবিদ্রুপ আজ বহুলাংশেই স্মৃতিচর্চার বিষয়ে পরিণত। কিন্তু ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, ব্যঙ্গবিদ্রুপের পাশাপাশি ভাষার তারতম্য লইয়া রঙ্গকৌতুকও কম তৈয়ারি হয় নাই। জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে নাটকে নকশায় তো বটেই, সাহিত্যের ভুবনেও ‘বাঙাল ভাষা’র কৌতুকী ব্যবহার অজস্র, এবং তাহার রসাস্বাদনে পূর্ববঙ্গীয় বাঙালি কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হয় নাই। এইখানেই সমাজ ও সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত শক্তির মহিমা। সেই শক্তি যাহা ‘যথাযথ’ নহে তাহাকেও সকৌতুকে গ্রহণের সহিষ্ণুতা দেয়।
কিন্তু ভাষা ও আচরণ যেখানে হিংস্রতার হাতিয়ার হিসাবেই ব্যবহার করা হইতেছে, সেখানে সহিষ্ণুতার স্থান নাই। ইহাও অনস্বীকার্য যে, তেমন হিংস্রতার প্রকোপ ক্রমাগত বাড়িতেছে, দুর্বল বা প্রান্তিকের অপমানের নিত্যনূতন প্রকরণ ‘জনপ্রিয়’ হইতেছে। বিশেষত, অন্য নানা দেশের পাশাপাশি ভারতেও আধিপত্যবাদী ক্ষমতাবানেরা তেমন নানা প্রকরণকে সমস্ত বহুত্ব দমন করিবার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিতেছেন, তাঁহাদের নির্ধারিত ‘মূলধারা’র ছকের বাহিরে থাকিলেই নানা অঞ্চলের অধিবাসীরা তাঁহাদের আক্রমণের শিকার হইতেছেন, ভাষার অপপ্রয়োগ সেই আক্রমণের একটি অস্ত্র। সাম্প্রতিক কালে বঙ্গভাষীরা এই অপপ্রয়োগের নিশানা হইয়াছেন, বিশেষত সমাজমাধ্যমে। এই আক্রমণ প্রতিরোধ করা অবশ্যই নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ভাষার স্বাধীনতা কোথায় কখন ভাষার সন্ত্রাসে রূপান্তরিত হইতেছে, তাহার বিচার সমাজকেই করিতে হইবে। সেই বিচার যতটা কঠিন, ততটাই জরুরি।
যৎকিঞ্চিৎ
কত কাণ্ড কাটমান্ডুতে। রামচন্দ্র নেপালি এবং অযোধ্যা নেপালে— এ আবিষ্কার আগেই করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী খড়্গপ্রসাদ শর্মা ওলি। সাম্প্রতিকতম নিরীক্ষা: যোগাসনের উৎপত্তিস্থলও নেপাল— ভারত তো সে দিনের ছোকরা, এ পাড়ায় নেপালই হল বর্ষীয়ান, ঐতিহ্যবান, বিচক্ষণতম। এখন, কথা হল, সীমান্তের এপার-ওপারে হঠাৎ কেন এই উৎসসন্ধানের প্রতিযোগিতা? কেননা, অতীত খুঁড়ে প্রতিবেশীর বেদনা জাগানোই এখন রাজনীতির সহজ পাঠ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy