—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
শব্দ ব্রহ্ম হতে পারে, কিন্তু সেই ব্রহ্ম নানা প্রসঙ্গে নানা রূপে প্রকাশিত হয়ে থাকেন। যেমন ধরা যাক ‘জনতার আদালত’ শব্দবন্ধটি। রাজনীতির নায়কনায়িকারা যখন জনতার আদালতের জয়গান করেন, তখন তাঁদের অভিধানে সেই কথার এক এবং অদ্বিতীয় অর্থ: ভোট। সমস্ত অভিযোগ, সব সমালোচনার জবাবে তাঁদের ব্রহ্মাস্ত্র: জনতার আদালতে বুঝে নেব, অর্থাৎ— ভোটে যদি জয়লাভ করি, তবে সাত কেন, সাতশো খুনও মাপ। কিন্তু জনতা নিজে সর্বদা সেই তত্ত্ব মেনে নেয় না। সে মাঝে মাঝেই নিজস্ব অভিধান হাতে তুলে নেয়, সেই অভিধানের পাতা উল্টে নিক্ষেপ করে তার আপন শব্দবাণ, ভোটযুদ্ধে বিজয়ী শাসকের গর্বিত মুখের উপর সপাটে জানিয়ে দেয়: চলবে না! পশ্চিমবঙ্গের রাজধানীতে চিকিৎসকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে প্রথমে মহানগরে এবং তার পরে রাজ্যের অসংখ্য বিন্দুতে যে জনজাগরণ দেখা গিয়েছে, তার সমস্ত বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যসূত্র ওই একটিই: অন্যায় অবিচার চলবে না। বিভিন্ন বর্গের, বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন মতের নাগরিক ক্রমাগত যে ‘ন্যায়বিচার চাই’ ধ্বনি তুলেছেন, তার উচ্চারণে কে কতটা আন্তরিক সেই প্রশ্নকে সরিয়ে রেখে একটি কথা নিঃসংশয়ে বলা চলে। এই আলোড়িত পক্ষকাল ধরে রাজ্যের অগণন মানুষ জনতার আদালত কথাটির অর্থান্তর ঘটিয়ে তাকে নিজেদের মতো করে চিনে নিয়েছেন এবং চিনিয়ে দিয়েছেন। জনতা সেখানে বিচার করে না, বিচার চায়। এই অর্থান্তরের সামনে রাজনীতিকের তৈরি করা অর্থটি অচল, কারণ ন্যায়বিচারের দাবিদার নাগরিক শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনীতিককে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চান: ভোটের কথা এই আদালতে অবান্তর, এখানে আমরা তোমার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে এসেছি, ভোটের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই, তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা।
জনতা স্বভাবত বৈচিত্রময়। গত দুই সপ্তাহ ধরে রাজ্য জুড়ে সেই বৈচিত্রের নিরবচ্ছিন্ন জনস্রোত দৃশ্যমান। সেই স্রোতে হয়তো বিস্তর বেনোজল ছিল, ছিল অপবাদের আশঙ্কা থেকে আত্মরক্ষার লোকদেখানো প্রদর্শনী, ছিল প্রতিবাদের ছলে আত্মপ্রচারের অলজ্জ প্রয়াস। কিন্তু সেই যুক্তিতে কখনওই তুচ্ছ করা চলে না এই সামাজিক উদ্যোগে বহু সুচেতন নাগরিকের আন্তরিক যোগদানের সত্যকে। সেই আন্তরিকতাকে নিছক কোনও বিমূর্ত নৈতিকতার প্রকাশ মনে করলে ভুল হবে, তার পিছনে ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও যন্ত্রণার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং শাসনক্ষমতার অধীশ্বরদের কাছে সুবিচারের দাবিতে যাঁরা সমবেত হয়েছেন, তাঁদের নিজের নিজের জীবনে অন্যায় অবিচারের যে সব অভিজ্ঞতা আছে, সেগুলি অবশ্যই অভিন্ন নয়। তাঁরা যখন একটি বিরাট অন্যায়ের ঘটনায় ক্ষোভে ও ক্রোধে ফেটে পড়েন তখন, সেই সম্মিলিত প্রতিবাদের মধ্যে, তাঁদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও নিহিত থাকে। জনপরিসরের প্রতিবাদী সংহতি এবং তার অভিন্ন স্লোগানগুলি স্বভাবতই ‘বিবিধের মাঝে মিলন’ হিসাবে প্রতিভাত হয়। কিন্তু সেই বড় ছবির পাশাপাশি এবং তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে নিহিত থাকে দৈনন্দিন অন্যায়ের মার খেয়ে চলা অজস্র জীবনের ছবি। আজ নয়, গত শতকের মধ্যপর্বের জনপ্রিয় গান সেই ছবি স্মরণ করে ক্লান্ত প্রশ্ন তুলেছিল: ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট ব্যথা, কে রাখে খবর তার?
রাজনীতির কারবারিরা যে সে খবর রাখবেন না, তা নিয়ে কারও মনেই কোনও সংশয় নেই। তাঁদের কাছে ব্যক্তিমানুষের দাম কেবলমাত্র তাঁর ভোট দিয়েই নির্ধারিত হয়। সেই দাম বুঝে নেওয়ার জন্য ব্যক্তিকে জনতার অংশ করে নেন তাঁরা, নির্মাণ করে চলেন নানা ধরনের জনতা। ধর্ম দিয়ে, জাত দিয়ে, আঞ্চলিকতা দিয়ে, অন্য নানা পরিচিতি দিয়ে নিজের নিজের অনুগামী জনতা তৈরি করে নেওয়াই রাজনীতির কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাস্তবটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে মানুষে মানুষে সচেতন সংহতির দৃশ্য দেখা যায় কেবল ক্ষমতাধারীর অন্যায়ের প্রতিবাদেই, অন্য কোথাও নয়— রণাঙ্গনে বা খেলার মাঠে যে ‘জাতীয়তাবাদী’ সংহতি, তার চরিত্রে সচেতনতার কোনও স্থান নেই। জনতার বৈচিত্রময় চেতনাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে নতুন রাজনীতি নির্মাণের কিছুমাত্র সম্ভাবনা কি আছে? ‘রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প’ নামক কেতাবি বুলিতে এই প্রশ্নের সদুত্তর মিলবে না। উত্তর খুঁজতে হবে জনতার অংশীদার ব্যক্তিনাগরিকের কাছেই। পারস্পরিক কথোপকথনের মধ্য দিয়ে একমাত্র তাঁরাই পারেন সেই নতুন রাজনীতির সম্ভাবনাকে নির্মাণ করতে। তারই নাম লোকনীতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy