একটি বৎসর শেষ হইয়া পরের বৎসর শুরু হইতেছে, ইহা ক্যালেন্ডারের সত্য। ইহাকে যদি বৃহত্তর সত্যের স্তরে উন্নীত করিতে হয় তবে প্রথম কর্তব্য: অতীত অভিজ্ঞতা হইতে শিক্ষা লইয়া আত্মসংশোধন। অনিবার্য প্রশ্ন: কাহার কর্তব্য? কে আপনাকে সংশোধন করিবে? দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হইয়া যাঁহারা সম্বৎসর নাগরিকদের উপর দাপট দেখাইয়া বিচরণশীল, সেই রাজনীতিকরা শুভবুদ্ধির প্রেরণায় নিজেদের রীতি এবং নীতি কিঞ্চিৎ পাল্টাইলে দেশের দশের মঙ্গল হয়, কিন্তু তাঁহাদের নিকট তেমন ভরসা করা বাস্তববুদ্ধির পরিচায়ক নহে। তাঁহাদের আচরণে পরিবর্তন আনিবার যদি কোনও উপায় থাকে, তাহা প্রেরণা নহে, তাড়না। ভোটের তাড়না। নাগরিকরাই সেই তাড়না দিতে পারেন। কিন্তু তাহার একটি আবশ্যিক শর্ত তাঁহাদের আত্মশুদ্ধি। সচেতন নাগরিককে সেই শর্ত পূরণের দায় স্বীকার করিতে হইবে। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ইতিহাসে তাহার কিছু সদর্থক অভিজ্ঞতা আছে। এক দশক আগে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পিছনেও নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল, ২০২১ সালে রাজনৈতিক আগ্রাসনের প্রতিরোধেও তাহার ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই পরিপ্রেক্ষিতেই সদ্য-বিগত বর্ষের শেষ দিনে এই স্তম্ভে লেখা হইয়াছিল “যখনই কঠিন পরিস্থিতি সামনে আসিয়া দাঁড়ায়, বাঙালি সমাজ বিভিন্ন ভাবে আশার উদ্ভাস তৈরি করিয়া চলে।” (প্রজ্বলিত, ৩১-১২-২০২১)। কথাটি কেবল পশ্চিমবঙ্গ নহে, সমগ্র ভারতের ক্ষেত্রেই অংশত সত্য। সেই সত্যকে আরও অনেক বেশি প্রসারিত এবং প্রবল করিয়া তুলিবার দায়িত্ব সঙ্গে লইয়াই আসিয়াছে স্বাধীনতার ৭৫তম বৎসরটি।
সমাজের দায়িত্ব বহুমাত্রিক। দুইটি মাত্রা বিশেষ প্রাসঙ্গিক। প্রথম দায়িত্ব সতর্ক প্রহরা। ‘নিরন্তর প্রহরাই স্বাধীনতার সত্যমূল্য’ কথাটি আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনই প্রথম বলিয়াছিলেন কি না তাহা জল্পনার বিষয়, কিন্তু কথাটির গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। স্বাধীনতার অর্থ নিছক রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব নহে। যথার্থ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে রক্ষা করিবার জন্য নাগরিকদের নিরন্তর অতন্দ্র প্রহরা কতখানি আবশ্যিক, বর্তমান ভারত তাহা প্রতিনিয়ত চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিতেছে। শাসকের অন্যায়, বিশেষত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করিয়া গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল করিবার উদগ্র অভিযান দেখিতে দেখিতে দেশের কী পরিমাণ ক্ষতি করিয়াছে তাহা নূতন করিয়া বলিবার কিছু নাই। কেবল কেন্দ্রীয় স্তরে নহে, রাজ্যে রাজ্যে এই সঙ্কট সুস্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গও সেই অ-গণতান্ত্রিকতার ব্যাধি হইতে মুক্ত নহে। সঙ্কটের মোকাবিলায় নাগরিকদের তৎপর সচেতনতার কোনও বিকল্প নাই।
দায়িত্বের দ্বিতীয় মাত্রাটি নাগরিকদের আপন সামাজিক কর্তব্য পালনের নৈতিক সঙ্কল্পের নির্দেশ দেয়। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ এবং তুচ্ছ দিনযাপনের সীমাকে অস্বীকার করিয়া, অতিক্রম করিয়া জনসমাজের সহিত আপন সংযোগ স্থাপনের চেষ্টাই যথার্থ সভ্যতার লক্ষণ। বর্তমান সামাজিক বাস্তবের সহস্র সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সেই লক্ষণ সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয় নাই। অতিমারির দুর্দৈবই তাহার একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করিয়াছে— বহু মানুষ বিপন্ন ও অসহায় সহনাগরিকদের পাশে দাঁড়াইবার জন্য আপন স্বাচ্ছন্দ্য, স্বার্থ, এমনকি প্রাণের মায়া তুচ্ছ করিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন, প্রতিবেশী হইতে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের স্বার্থে যথাশক্তি সাহায্যের হাত বাড়াইয়া দিয়াছেন। ইহাই আত্মশক্তির নিদর্শন, যে আত্মশক্তির কথা রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন। সমকালীন অর্থনীতি এবং রাজনীতির যৌথ ও সমন্বিত প্রভাবে এই শক্তির ক্ষয় হইয়াছে বিপুল ভাবে, কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর প্রভাবও তাহাকে সম্পূর্ণ বিনাশ করিতে পারে নাই। নূতন বৎসরে সেই আত্মশক্তির নূতন অভিযান সার্থক হইবে কি না, তাহাই সমাজের সম্মুখে, প্রত্যেক সুনাগরিকের সম্মুখে বড় প্রশ্ন। জীবনমরণের প্রশ্ন বলিলে অত্যুক্তি হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy