Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2021

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজ

মন্ত্র হারাইয়া যায়, পূজাপদ্ধতি রহিয়া যায়। বলির পশু, বলিদানের খড়্গ এবং উপাস্য দেবী একই ভাবে পূজার্হ, নীলকণ্ঠ পাখি জানে।

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২১ ০৬:৫৫
Share: Save:

অনন্তর দ্বাদশীর প্রভাতে নীলকণ্ঠ পাখিটি মেঘলোকে উড্ডীন হইয়াছিল। এই পরিস্থিতিতেও তাহার ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ নাই, প্রতি বার দুর্গা পূজার শেষে তাহাকে কৈলাস পর্বতে গিয়া দেবীর প্রত্যাবর্তনের আগাম সংবাদ জানাইতে হয়। মাঝে পূজাশেষে কার্নিভাল হইত, রেড রোডে একের পর এক প্রতিমা শোভাযাত্রায় আসিত। মহানগরীর লোকেরা কোনও দিন তিথি-নক্ষত্র মানে না, মণ্ডপ-প্রতিমা-আলোকসজ্জায় পুরস্কার পাইলে তো কথাই নাই। দশমীর পরেও তাহারা প্রতিমা নিরঞ্জন দেয়। পাখি মাঝে খুব ধন্দে পড়িয়াছিল। সে কি তিথি মানিয়া দশমীতেই উড়িবে, না কি কার্নিভালটি দর্শন করিবে! এ বার সে ঝঞ্ঝাট নাই। কোভিড পরিস্থিতির দরুন এই বৎসরও কার্নিভাল বন্ধ— প্রশাসন অবশ্য বলিয়াছিল যে, অঞ্জলি দিতে বা সিঁদুর খেলিতেও কোভিড টিকার শংসাপত্র লাগিবে, কিন্তু সেই কথা থাকুক। পাখি খুব ভয়ে ভয়ে ছিল। বাঙালি বরাবর দুষ্ট বুদ্ধিতে বলীয়ান, ধরিয়া আনিতে বলিলে বাঁধিয়া আনে। কে দেব, কে অসুর, নিজেরাও বুঝে না। আজ যাহারা বিশ্বাসঘাতক শুম্ভ-নিশুম্ভ, দল বদলাইলে কাল তাহারাই সম্পদ। নীলকণ্ঠ কাহাকে কী বলিবে? মিথিলায় ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’র কবি বিদ্যাপতি ঠাকুরের দেশে প্রণাম করিয়া আসিবে ভাবিয়াছিল, দিকবিভ্রমে তরাই অঞ্চলে অন্য আকাশে ঢুকিয়া পড়ে। সেখানে রক্তের ছোপ। পাখি জানিল, ইহার নাম লখিমপুর খেরি। পূর্বে দেবীর বাহন সিংহ অসুরদের আক্রমণ করিয়া ছত্রভঙ্গ করিত, এখন চাষিদের পিষিয়া মন্ত্রী-পুত্রের গাড়ির চাকা চলিয়া যায়। নীলকণ্ঠ উড়িতে উড়িতে আপন মনে ঘাড় নাড়ে। মেধাতিথি ঋষির আশ্রমে রাজ্যহারা নৃপতি সুরথের কথা মনে পড়ে। সুরথ শ্রীচণ্ডীর পূজা শিখিয়া রাজ্য পুনরুদ্ধারে সক্ষম হইয়াছিলেন। শাস্ত্রমতে দুর্গা পূজা রাজারাজড়াদেরই করণীয়। এখন রাজা নাই, সেই রাম ও অযোধ্যা কিছুই নাই। আহা, শ্রীরামের কী ভক্তি ছিল! লঙ্কাবিজয়ের পূর্বে নীল পদ্ম খুঁজিয়া না পাইয়া শরাঘাতে নিজের চক্ষু দুইটি উৎপাটনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। আধুনিক ভারত এই ভক্তি দেখিল না। কেবল শ্রীরামকে যুদ্ধের হুঙ্কারকারী প্রতিপন্ন করিল। মায়ের নির্দেশে ফি বৎসরে আসিতে হয় ঠিকই, কিন্তু এই দেশে আসিলে নীলকণ্ঠ পাখির কষ্ট হয়।

এই যে বিজয়া দশমীর দিন সকলে পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে জাতপাত ভুলিয়া গুরুজনদের পদধূলি লইয়া বন্ধুদিগের সহিত কোলাকুলিতে মাতে, ইহা অন্ত্যজ শবরদের প্রথা। পুরাকালে ইহার নাম ছিল শবরোৎসব। মহাশক্তির পূজায়, বিসর্জন পদ্ধতিতে সকলকে ঠাঁই দেওয়া হইয়াছিল। তাহার পরও এই দেশে জাতপাত, ধর্ম, দলিত-উচ্চবর্ণে এত হানাহানি কেন, পাখি বুঝিয়া পায় না। নূতন আর এক বিভাজন ক্রমে দৃষ্টিগোচর হইতেছে। নিরামিষাশী ‘নবরাত্রি’ বনাম মৎস্য-মাংস ভক্ষণে সিদ্ধ বাঙালির দুর্গা পূজা। নিরামিষ এবং ভেগানই যে সেরা আহার্য, এ কথা কোন শাস্ত্রবিদ ঘোষণা করিল? বাঙালিরাও তদ্রূপ। জানে না বলিকে প্রথমে পূজা করিতে হয়, মুখ ও নাসিকাদ্বয়ে সরস্বত্যৈ নমঃ, সর্বাঙ্গে ওঁ ছাগপশ্বাধিষ্ঠাতৃদেবতাভ্যো নমঃ বলিয়া প্রণাম করিতে হয়। তীক্ষ্ণধারায় শুদ্ধায় তস্মৈ খড়্গায় তে নমঃ বলিয়া বলিদানের খড়্গটিকেও প্রণাম করিতে হয়। পাখির মনে পড়ে, যে কারণে একদা প্রতিমা নিরঞ্জনের পর খাঁড়াটিকে অনেক বাড়িতে রাখিয়া দেওয়া হইত। মন্ত্র হারাইয়া যায়, পূজাপদ্ধতি রহিয়া যায়। বলির পশু, বলিদানের খড়্গ এবং উপাস্য দেবী একই ভাবে পূজার্হ, নীলকণ্ঠ পাখি জানে।

এই মাতৃমূর্তি কি কেবল কন্যারূপে তিন দিন মা মেনকার কাছে কাটাইতে আসে? এই দ্বাদশীর প্রভাতে মেনকার ‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা নাকি বড় কেঁদেছে’-র আগমনী শুধুই অতীতের স্মৃতি। পতিগৃহে প্রত্যাবর্তন অবশ্যই দুঃখের। কিন্তু ‘পুত্রায়ুর্ধনবৃদ্ধ্যর্থং স্থাপিতাসি জলে ময়া’ বলিয়া দশমীতে দেবীকে জলস্থাপনের পরও মনুষ্যলোকে তাহার কিঞ্চিৎ কর্তব্য বাকি রহিয়া যায়। শাস্ত্রীয় নির্দেশ স্মরণ করা যাইতে পারে, “ঘটোদকে শান্তি করিবে, দক্ষিণ হস্তে শ্বেত অপরাজিতা বন্ধন করিবে, তালপত্রাদিতে কিঞ্চিৎ লিখিবে।” এক্ষণে এই সব প্রাচীন আচার কেহ মানে না। শান্তির কথাও কেহ দুই দণ্ড

যৎকিঞ্চিৎ

শ্রীভূমির বুর্জ খলিফার আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে, অভিযোগ করেছেন বিমানচালকরা। তো? তার জন্য পুজো বন্ধ করে দিতে হবে? হরেক পুজোর জন্য বাসরুট ঘুুরে যাচ্ছে, বাড়ি থেকে বেরোতে হলে আধার-পাসপোর্ট-এনআরসি’র কাগজ পকেটে রাখতে হচ্ছে, অ্যাম্বুল্যান্সকে শুনতে হচ্ছে ‘দ্বাদশীর পরে আসুন’, এমনকি নিজের বাড়ির বাথরুমেও যেতে হচ্ছে অন্য পাড়া হয়ে, কলকাতার লোকজন মেনে নিচ্ছে না? প্লেন বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে? একটু অন্য দিক দিয়ে ঘুরে গেলেই হয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2021
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy