অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত বিপদ বোঝাতে ‘দুর্ঘটনা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। জলপাইগুড়ির জল্পেশ মন্দিরে যাওয়ার পথে চলন্ত গাড়িতে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে যে ভাবে দশ জন মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারালেন, তা দুর্ঘটনা হলেও অপ্রত্যাশিত বোধ হয় ছিল না। তদন্তে প্রকাশ, গাড়িতে পুণ্যার্থীদের ভিড়ের সঙ্গেই তোলা হয়েছিল ডিজ়েলচালিত জেনারেটর এবং ডিজে বক্স। চালকের কেবিনের ছাদেই রাখা ছিল গান বাজানোর যন্ত্র। প্রবল বৃষ্টিতে সেটি তড়িৎবাহিত হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে দশ জন প্রাণ হারান। এবং পুণ্যার্থীরা নাকি এতটাই নেশাগ্রস্ত ছিলেন যে, চোখের সামনে এত জন বিদ্যুৎপৃষ্ট হওয়ার পরও গাড়ি থামাতে বলা বা দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়নি।
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে দেয়। যে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উৎসবকে ঘিরে সম্প্রতি যে লাগামছাড়া উন্মত্ততার চিহ্ন প্রকাশ্যে আসছে, তাকে আটকানোর দায়িত্ব কি পুলিশ-প্রশাসনের নয়? জল্পেশের পুণ্যার্থীরা কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতা তো নতুন নয়। দীর্ঘ দিন ধরেই শ্রাবণ মাসে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পুণ্যার্থীরা মন্দিরে যাওয়ার পথে ঠিক এমনই বেপরোয়া, উদ্দাম আচরণ করে থাকেন। প্রতি বছরই নিয়ম করে নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে এই সময়। তা সত্ত্বেও এই উদ্দামতাকে নিয়ন্ত্রণের সামান্যতম প্রচেষ্টা পুলিশ-প্রশাসনের তরফে চোখে পড়ে না। কলকাতা থেকেও তারকেশ্বরে যাওয়ার পথে এমন ছোট ছোট ভ্যান বা লরিতে পুণ্যার্থীরা তারস্বরে নিষিদ্ধ ডিজে বক্স বাজিয়ে, প্রকাশ্যে নেশা করতে করতে যাত্রা করেন। রাস্তার পাশের অস্থায়ী বিশ্রামাগারগুলি রাত্রিতে কার্যত শব্দতাণ্ডব এবং নেশার আখড়ায় পরিণত হয়। পুলিশ-প্রশাসন এই রীতিকেই কি বর্তমানে পুণ্যলাভের মাপকাঠি হিসেবে ছাড় দিয়েছে? থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক যখন জানান, এই সব ক্ষেত্রে বুঝিয়েসুঝিয়ে কার্যোদ্ধারের নির্দেশ এসেছে উপরমহল থেকে, তখন অনুমান করা যায় এই সকল দিনে পুণ্যার্থীদের দাবিকে আইনেরও ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়। এবং যত ক্ষণ না দুর্ঘটনার মাত্রা ও প্রাণহানির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি হয়, তত ক্ষণ অবধি কোনও ব্যবস্থার কথা ভাবাও হয় না।
আসন্ন উৎসবের মরসুম তাই আশঙ্কা জাগায়। আশঙ্কার কারণ, পশ্চিমবঙ্গ ইতিপূর্বে ‘ছোট ছেলে’দের ‘দুষ্টুমি’তে অবাধ প্রশাসনিক প্রশ্রয় দেওয়ার নানা নমুনা দেখেছে। সেই প্রশ্রয়ে ভর করেই বছরের পর বছর কালীপুজোয় নিষিদ্ধ বাজি ফেটেছে, সবুজ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও ছটপুজোয় রবীন্দ্র সরোবর, সুভাষ সরোবরের পরিবেশ দূষিত হয়েছে। এ কথা সত্য যে, ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা শুধু এই রাজ্যের নয়, সারা ভারতের চিত্র। কিন্তু অন্যরা অধম হলে নিজে উত্তম হওয়া কেন যাবে না, সেই আত্মসমীক্ষারও প্রয়োজন আছে বইকি। বিশেষত রাজ্যের শাসক দল যখন প্রায়শই বাংলার এগিয়ে থাকার দাবি করে, তখন এই ক্ষেত্রে কেন সে জোয়ারে গা ভাসাবে? উৎসব কখনও বিশৃঙ্খলার নামান্তর হতে পারে না। পুণ্যার্থীরা যদি পুণ্যলাভের প্রবল তাড়নায় এই অমূল্য কথাটি বিস্মৃত হয়, তবে প্রয়োজনে কড়া হাতে কথাটি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও প্রশাসনেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy