(১) লেসার অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক বা মদনটাক। (২) ফরেস্ট ওয়াগটেল বা জংলি খঞ্জনা। (৩) গ্রে ফ্র্যাঙ্কোলিন বা ধূসর তিতির। অণ্ডালে ক্রমেই সংখ্যা কমছে এই সব পাখির। ছবি: লেখক
আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প তালুক হল অণ্ডাল। অণ্ডাল, একটি মফস্সল অঞ্চল হিসেবে পরিচিত হলেও এটি দ্রুত উন্নীত হচ্ছে বিশ্বের দরবারে। মূলত বাণিজ্যিক উন্নয়নের কারণে। অঞ্চলটি শুধু প্রাচীনই নয়, এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র আকর্ষণ করেছে বহু প্রকৃতিপ্রেমীকে। গ্রাম ও শহরের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। নানা শিল্প থাকলেও মূল ভিত্তি কয়লা শিল্প। সড়কপথ, রেলপথের পাশাপাশি, নবনির্মিত বিমানবন্দরটি আকাশপথে যোগাযোগ খুলে দিয়েছে।
সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন দ্রুততার সঙ্গে ঘটেছে, তেমনই দ্রুততার সঙ্গে এই অঞ্চল সবুজ হারিয়েছে। সবুজকে সরিয়ে নির্মিত হয়েছে বিমান নগরী। তৈরি হয়েছে সুউচ্চ ফ্ল্যাটবাড়ি। বনাঞ্চল ও কৃষিজমির পাশাপাশি, ধ্বংস হয়েছে এখানকার জলাভূমি। যা নিশ্চিত ভাবে কেড়ে নিয়েছে অগুনতি পশুপাখির সুখী গৃহকোণ। এই অঞ্চলের মূল প্রবেশ দ্বারে গড়ে ওঠা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র দ্রুত বদলে দিয়েছে এখানকার আবহাওয়াকে।
তবে এতে খুব একটা প্রভাবিত হয়নি আমাদের রোজনামচা। আমরা হয়তো খেয়ালও করিনি গত আট বছর ধরে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নানা রূপে সেজে উঠত যে অণ্ডাল, আজ সে যেন বেশ ধূসর। নিরন্তর আঘাতে জর্জরিত। উন্নয়নের গ্রাসে হারিয়েছে পাখির আবাস। হারিয়ে গিয়েছে শেয়াল, বেজি বা গোসাপের নিরিবিলি আস্তানাগুলিও। বনাঞ্চলে রুক্ষতার ছাপ আসায় কমেছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা।
অণ্ডাল এক সময়ে ছিল জীব বৈচিত্রের খনি। এই অঞ্চলটি ভৌগলিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। পশ্চিম বর্ধমান জেলার দু’টি বিখ্যাত নদ অজয় ও দামোদরের অববাহিকা অঞ্চলে গড়ে উঠেছে এই অঞ্চল। এক দিকে হাওড়া-দিল্লি রেলপথ, অন্য দিকে এনএইচ-২-এর মাধ্যমে সড়ক পথে যোগাযোগ। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটিয়েছে। ভূপ্রকৃতির মধ্যেও তারতম্য লক্ষণীয়। কোথাও বনাঞ্চল তো কোথাও ফাঁকা ধুধু জমি। কৃষিকাজের আবাদি জমির পাশাপাশি, আছে খনি অঞ্চল। তাই সব মিলিয়ে বৈচিত্রময় এই অঞ্চলটি আকর্ষক হয়ে উঠেছিল মানুষ থেকে পশুপাখি সকলের কাছে। ভূপ্রকৃতির বিভিন্নতার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে এখাকার জীব বৈচিত্রের উপরে। পাখির কথা বলতে গেলে অবাক হতে হয়। ঋতুভেদে এখানে বিভিন্ন পাখির দেখা মেলে। প্রায় ১৫০ প্রজাতির পাখির সন্ধান মিলেছে এই অঞ্চলে। পাখির পাশাপাশি, প্রজাপতি, ফড়িং ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ-সহ সরীসৃপ, উভচরের উপস্থিতি অনেক প্রকৃতি পর্যবেক্ষকের নজর কেড়েছে। শিয়াল, খেঁকশিয়াল, বেজি, বনবিড়াল ও বন খরগোস এই অঞ্চলের বড় পশুদের মধ্যে অন্যতম।
এই অঞ্চলের প্রতি শিকারি পাখিদের একটি বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়। ১২ প্রজাতির র্যাপ্টার এই অঞ্চলের পাখির তালিকাকে সমৃদ্ধ করেছে। যার মধ্যে পেরিগ্রিন ফ্যালকন ও রেড-নেকড ফ্যালকনের নাম বিশেষ ভাবে করতে হয়। এ ছাড়াও, বলতে হয় শর্ট-ইয়ার্ড আউলের কথা। লেসার অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক বা মদনটাক এবং উলি-নেকড স্টর্ক বা মানিকজোড় এই অঞ্চল থেকে পাওয়া অন্যতম দু’টি পাখি যারা ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’ (আইইউসিএন) তালিকায় বিপদ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। বনাঞ্চল থেকে পাওয়া গেছে বর্ণালি, জংলি খঞ্জনা, দুধরাজের মতো নামী পাখিদের দেখা। সাপের মধ্যে কালাচ এবং চন্দ্রবোড়া ছাড়াও এই অঞ্চলে খরিসের দেখা পাওয়া যায়। হলুদ মনিটার লিজার্ড এখানে পাওয়া গিয়েছে বিমান নগরী প্রকল্পের একটি হাইড্রেন থেকে। এ ছাড়াও, সরীসৃপদের মধ্যে ফ্যান-থ্রটেড লিজার্ডের নাম করতেই হয়। এক সময়ে এখানে লালমুনিয়া বা পাতা ফুটকিরা লম্বা ঘাসের মধ্যে থেকে উঁকি মারত।
বর্ষায় এই অঞ্চল সেজে ওঠে অপরূপ সবুজের সাজে। সেখানও বৈচিত্র কম নেই। এক দিকে বনাঞ্চল যেমন কচি সবুজ পাতা আর সবুজ ঘাসের গালিচা বিছিয়ে দেয়, অন্য দিকে জমা জলে এসে ভিড় জমাতো জিরিয়া, পানলৌয়া, কাদাখোঁচা, বালু বাটান আর বাবুইবাটানদের দল। সঙ্গে অবশ্য চার রকমের খঞ্জনা, সরাল, কোরা আর হাটিটিরা। এ ছাড়াও, জলাভূমিগুলিতে আছে জলপিপি, জলময়ূর, জলমোরগ, ডাহুক, ডুবুরিহাঁস, বালিহাঁস প্রভৃতি। শিকার এবং কাপাসির সঙ্গে কেস্ট্রাল-এর হাওয়াই কসরত চোখ জুড়িয়ে দেয়। উড়তে উড়তে ঝুপ করে ধান জমিতে নেমে এসে মেঠো ইঁদুর তুলে নিয়ে যাওয়াও দেখার মতো। রাস্তার ধারের ইলেকট্রিক তারে বসে থাকে রকমারি আবাবিল, তাল চড়াই এবং হাওয়াশীলরা। শীতের সময় সারা মাঠ জুড়ে সবুজ বাঁশপাতিদের রাজত্ব আর বর্ষায় নীললেজ বাঁশপাতিদের। মোহনচুড়ার চুড়া খুলে মাঠে হেঁটে চলা বা মাঠের মাঝ থেকে তিতিরের একটানা ডাক শোনা যেত। কিন্তু এখন শিল্পাঞ্চলের ছাই-এ পাতার রঙ কালো হয়ে গিয়েছে। এখন শীতের কুয়াশার সঙ্গে ধোঁয়াশা মিশে গিয়েছে। নাগরিক সভ্যতার লোভে বিপন্ন অণ্ডালের জীববৈচিত্র। আমরাই তিলে তিলে তাকে এগিয়ে যাচ্ছি শেষের দোর গোড়ায়।
সিয়ারশোল নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy