গত কয়েক দিনে আমরা ক্রমশই অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। বাড়ির ছোট সদস্যটির বাস আর ঠিক সময় বাড়ির সামনে আসবে না। আপনাকে, আরও অনেক অভিভাবকের মতোই প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা নিয়ে খোঁজখবর করার চেষ্টা করতে হবে, ফোন আর ইন্টারনেট কানেকশনের বাধা পেরিয়ে। প্রতি দিনই এক বা একাধিক রাজ্যের ইন্টারনেট বন্ধ থাকবে, তাই ফোনে চেষ্টা করলেই যে কানেকশন পাওয়া যাবে না, সেটাও ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। স্বামী বা স্ত্রী অফিস থেকে না ফেরা পর্যন্ত সেই অস্বাভাবিক দুশ্চিন্তা করে যেতে হবে। টিভির পর্দায়, রেডিয়োর খবরে কান পেতে থাকতে হবে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সন্তানের স্কুলের আশেপাশে, বড়দের অফিসের রাস্তায় কোনও অবরোধ হয়নি তো? হঠাৎ করে আগুন জ্বলছে না তো কোনও বাসে, ট্রামে? অন্যান্য শহরে তো শুনতে পাচ্ছি মাঝে মাঝেই মেট্রো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এখানেও সে রকম কিছু হয়নি তো?
এই শহর কিছু দিন আগে অবধিও ‘মিছিলের শহর’, ‘বন্ধের শহর’ বলে খ্যাত বা কুখ্যাত ছিল। মিছিলে আটকে বিরক্তি প্রকাশ, কাজে দেরি হয়ে যাওয়া, অ্যাম্বুল্যান্সেরও তার থেকে পরিত্রাণ না পাওয়া— এ সব নিয়ে অনেক শব্দ খরচ হয়েছে। তা-ও, তফাত আছে। বিরক্তি নিয়ে, ক্ষোভ নিয়ে বাঁচা যায়। আতঙ্ক নিয়ে বাঁচা যায় না।
১৩ ডিসেম্বর, শুক্রবার। নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে কলকাতার প্রথম ক্ষোভ প্রদর্শন। ঠিক এই সময়ই ছুটি হয় একাধিক স্কুল। বাসে আটকে পড়ে অসংখ্য স্কুলপড়ুয়া। স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত, স্বাভাবিক ভাবেই পূর্ব ঘোষণা ছিল না। জানা ছিল না স্কুলবাসের, তাদের অভিভাবকদের, স্কুলপড়ুয়াদেরও। আতঙ্কের অবরোধের সঙ্গে তাদের চেনা ছিল না। খিদে পাওয়ায় তারা চিপস্ বা জলের বোতল কিনতে স্কুলবাস থেকে নামতে চেয়েছে— যেমনটা বাস হঠাৎ খারাপ হলে করে থাকে। বাসের দিদি, ড্রাইভার কাকুর চোখেমুখে কেন এত ভয়, কেন এত পুলিশের গাড়ি তারা বুঝতে পারে না। এই আতঙ্কের শহর তাদের চেনা নয়।
তার পর শুরু হয় স্কুলে যেতে না পারা, কিংবা চাইলেও যেতে না দেওয়া। স্কুলের সময় বদলানো, পরীক্ষা বাতিল ইত্যাদি আপৎকালীন চেষ্টা শুরু হয়। স্কুলে শিক্ষিকাকে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেন বাবা-মা, উত্তর পান না। বাবা-মা অসহায়, চিন্তিত। এই অসহায়তার ছবিও তাদের চেনা নয়।
যেমন চেনা নয় বহুভাষী বহুধর্মের স্কুলে বন্ধুদের মধ্যে ভাগাভাগির ছবি। বন্ধুদের মধ্যে শহরের নাম ছিল, চিহ্নিতকরণও ছিল, কিন্তু ভাগাভাগি ছিল না এমন ভাবে। তার ঠিক পাশের বেঞ্চিতে বসা বন্ধুর পদবি আলাদা, মূল উৎসব আলাদা, এ সব সে জানত। কিন্তু নতুন নিয়মের ফলে নাকি তার বন্ধু এই দেশে থাকতেই পারবে না। এমনটাও হতে পারে? এই অবিশ্বাসও তার, তাদের চেনা নয়।
যেমন চেনা নয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বদলে যাওয়া মুখ, আরও একটু বড় হয়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মুখ যারা, তাদের বক্তব্যে ছেয়ে যায় ক্লাসরুমের বাতাস। আপনার ছেলে বা মেয়েটি সেই সব শব্দ শোনে, জেনে বা না-জেনে, বুঝে বা না-বুঝে সেই শব্দের পুনরুচ্চারণ করে। কখনও এ পুনরুচ্চারণ আপনার মতের কাছাকাছি দিয়ে যায়। আপনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। কখনও আতঙ্কিত হন সন্তানের মুখে তোতাপাখির ঘৃণার বচনে। এই ঘৃণার শৈশব তাদের নয়।
আপনার সন্তান যদি শহরের বাইরে থাকে, পড়াশোনা করে অন্য শহরে, তা হলে অারও এক বিরাট আতঙ্কের বলয়ে বাস করেন আপনি, আরও অনেকের মতোই। কোনও বিশেষ ধর্মের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি আস্ফালনের সম্ভাবনা বেশি, এ ধরনের আংশিক স্তোকবাক্যের উপর ভরসা করেন। আপনার সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম, তার ধর্মজনিত পদবির উপর ভরসা করছেন। আর প্রাণপণ ভাবতে থাকেন, জন্ম বা বিবাহসূত্রে পাওয়া পদবির আস্ফালনের ভরসায় না থেকে আপনি আপনার সন্তানের জন্য কী করতে পারেন, কাকে বিশ্বাস করতে পারেন, আদৌ বিশ্বাস করতে পারেন কি না।
সংবিধানের ভরসা ছিল এত দিন— সরকার বা প্রশাসন বা পুলিশের ভরসা তো ছিল না কোনও দিনই। জাতীয় পতাকা সবার, হয়তো উন্নাওয়ের মেয়েটিও তা বিশ্বাস করত। ধর্ষণের ভয়ে আধমরা হয়ে, দুর্নীতি-দারিদ্রে আধপেটা হয়েও জাতির জনকের নামটা জানা ছিল।
জাতীয় পতাকা হাতে, জাতির জনকের ছবি নিয়ে মার খাচ্ছে আপনার-আমার সন্তানেরা। শহরের রাজপথে, তাদের নিজেদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। কখনও নিজের শহরে, কখনও আবার আর একটু দূরের শহরে। কখনও লাইব্রেরিতে, কখনও শৌচাগারেও।
আপনি, আমি আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের পদবি, রাজনীতির ছাতার তলায় এখনও চুপ করে বসে। সন্তানের লাশ চিনতে ভয় পাওয়া মৃত্যু উপত্যকা আমার শহর নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy