প্রত্যাঘাত: নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাতে প্রবল নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। গাঁধীনগর, ২৩ অক্টোবর। ছবি: পিটিআই
একটা পাঁচশো টাকার পুরনো নোট। তাতেই বরবাদ হতে চলেছিল আমার জার্মানি-যাত্রা! গত বছর নোটবন্দির তিন দিনের মাথায় কুড়িয়েবাড়িয়ে, লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙে পঞ্চাশ-একশো এমনকী দশ-কুড়ির নোট জোগাড় করে ‘শেঙ্গেন ভিসা’র জানালায় এসে বুঝলাম, ভিসা ‘ফি’-র নির্দিষ্ট মূল্যের চেয়ে সাড়ে তিনশো টাকা কম পড়ছে, ভিসা এজেন্সির লোকেরা পুরনো পাঁচশো নেবে না, কার্ডেও না, আশপাশের ব্যাংকে নোট–বুভুক্ষু গ্রাহকের লাইনও অ্যানাকোন্ডার চেয়ে দীর্ঘ সর্পিল। ভিসায় দেরি হলে প্লেনের টিকিটের দাম অনেকটা বেড়ে যাবে, অগত্যা ট্রাভেল এজেন্টের কাছ থেকে ধার নিয়ে কোনও মতে বেঁচেছিলাম!
অনেকেরই অবশ্য এতটা ‘সৌভাগ্য’ ছিল না। প্রায় দু-মাস গোটা জাতিই নাওয়া-খাওয়া ভুলে কোনও-না-কোনও ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়েছিল। লাইনে দাঁড়িয়ে বা তার ধাক্কায় শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছিল। জনগণের উদ্দেশে নরেন্দ্র মোদীর ‘মিত্রোঁ’ সম্বোধন অচিরেই নিষ্ঠুর পরিহাস হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। অমর্ত্য সেনসহ বহু অর্থশাস্ত্রী এর প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই নোটবন্দির বর্ষপূর্তির কিছু আগে জাতীয় স্তরে কংগ্রেস, তৃণমূল, বাম দলগুলিসহ ১৮টি বিরোধী দল ৮ নভেম্বর ‘কালা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর বিরোধীদের এই ডাকের কিছু সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ওই দিনটিকে ‘কালা-ধন-বিরোধী’ দিবস হিসেবে পালনের দলীয় সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছেন, যাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদেরও যোগ দেওয়ার কথা।
এবং এখানেই খানিকটা উলটপুরাণের শুরু। সরকারের নীতির বিরুদ্ধে বিরোধীরা আন্দোলন করবে, সেই আন্দোলনের বিষয় তারাই ঠিক করবে, এমনটাই সংসদীয় রাজনীতির দস্তুর। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র দামোদর মোদীর উত্থানের পর থেকে এর বিপরীতটাই ঘটেছে। মোদী-কৃত ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে, অনেকটা ইন্দিরা গাঁধীর স্টাইলে, প্রধানমন্ত্রীই শেষ কথা বলেন। এমনকী দল ও সরকারের বাইরে যে বড় তথা জাতীয় রাজনীতি, তার ‘অ্যাজেন্ডা’ ঠিক করে দিয়েছেন তিনিই। সেই অনুসারেই বিরোধীরা সংসদের ভিতরে ও বাইরে ‘প্রতিক্রিয়া’ জানিয়ে এসেছে। যেমন, গত এক বছর ধরে নোটবন্দি কিংবা জিএসটি নিয়ে। কিন্তু সাড়ে তিন বছরে এই প্রথম, ৮ নভেম্বরকে ‘কালা দিবস’ হিসেবে আগে ঘোষণা করে কংগ্রেসসহ বিরোধীরাই জাতীয় রাজনীতির এই নতুন অ্যাজেন্ডাটি নির্ণয় করেছে, বিজেপির ‘কালা-ধন-বিরোধী’ দিবস তার ‘প্রতিক্রিয়া’। তার মানে, জাতীয় রাজনীতির স্নায়ু-যুদ্ধে এ ক্ষেত্রে তারা কিছুটা পিছিয়ে।
অথচ, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে মোদীর সাফল্য ও আত্মবিশ্বাসের গ্রাফ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর অভিনব আহ্বান থেকে রেডিয়োতে জনগণের সঙ্গে সংযোগকারী ‘মন কী বাত’, সবেতেই তিনি বিপক্ষকে ঘোল খাওয়াচ্ছেন। এমনকী, আগের জমানার প্রকল্প— মঙ্গলগ্রহে মহাকাশযান প্রেরণ বা সীমান্ত পেরিয়ে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ (সামরিক বাহিনী আগেও এমনটা করেছে)— সবই তাঁর দৃপ্ত নেতৃত্বের ফসল, এমন বার্তায় আমজনতা সুখে মজেছে। যে নোটবন্দিতে মানুষের এমন হয়রানি, তাও যে আসলে কেবল ‘কালা পয়সাওয়ালা’ বড়লোকদের সমস্যা, মেহনতি আমজনতার তাতে কিছু যায় আসে না, এমন ধারণাও বিকিয়েছে ভাল। এর সঙ্গে মিঠেকড়া বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির অনুপান: ‘গোরস্থান বনাম শ্মশানঘাট’-এর কৌশলী উচ্চনিনাদ চর্চা পুরনো ‘মন্দির-মসজিদ’ ধর্মীয় পৃথগীকরণের বাইরে সামাজিক বিভাজন ঘটিয়েছে। ফল: অভূতপূর্ব সমর্থনে ইউপির মসনদে যোগী আদিত্যনাথ! একই কায়দায় ‘গরু’কে সামনে রেখে একক বিজেপি অবশ্য বিহারের নির্বাচনে লালু-নীতীশ জোটের কাছে দাঁত ফোটাতে পারেনি। কিন্তু বছর ঘুরতেই জোট ছেড়ে নীতীশ ফের বিজেপির ঝুলিতে! যদিও নতুন জোটেও তিনিই মুখ্যমন্ত্রী, তবু বিজেপির কাছে নীতীশের গুরুত্ব যে কমছে, তা বোঝা গেল কিছু দিন আগের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণপত্রটুকু না পাওয়ায়, বা ওই সম্প্রসারণে তাঁর দলের কারও স্থান না হওয়ায়।
এই সাফল্য-গাথার তাল কিন্তু গত দু’তিন মাসে মাঝেমধ্যে কাটছে। অস্বস্তির কিছু চিহ্ন ফুটতে শুরু করেছে। প্রথম খবরটি এসেছে রিজার্ভ ব্যাংকের কাছ থেকে। ব্যাংক-কর্তারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৮ নভেম্বর থেকে পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার প্রায় ৯৯ শতাংশই ব্যাংকে জমা পড়েছে! অস্যার্থ, এত টাকা ব্যয়ে নতুন নোট ছাপিয়ে, পুরনো নোট বাতিল করে এবং প্রায় দু’মাস ভারতবাসীর বিপুল দুর্ভোগ ঘটিয়ে যে বহ্বারম্ভটি হল, তার নেট ফল প্রায়-শূন্য! তবে এই সরকারি তথ্যেও জেটলি মচকান না। তাঁর বাণী, ধৈর্যং রহু। অচিরেই জমা দেওয়া টাকার মালিকদের দরজায় দরজায় আয়কর আধিকারিকরা পৌঁছবেন। ক্রমে ‘অচ্ছে দিন’ আসবে।
কিন্তু ‘যবে ষাট মণ তেল পুড়বে, তবে রাধা নাচবে’ জাতীয় আশ্বাসে জনতার আর খুব একটা বিশ্বাস নেই। বিদেশ থেকে উদ্ধার করা ‘কালো টাকা’ থেকে সবার অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা ঢুকবে, এমন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মানুষজন আলংকারিক অর্থেই নিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকেই ভেবেছিলেন, মনমোহন সিংহের তথাকথিত নীতিপঙ্গুতা কাটিয়ে মোদী অর্থনীতির পুনর্জাগরণ ঘটাবেন, নির্মাণ শিল্পে জোয়ার বইবে, বহু মানুষ কাজ পাবেন। অথচ, এই আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৫.৭ শতাংশের তলানিতে ঠেকেছে। এই আর্থিক মন্দার ওপর ‘খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় পরিকাঠামোহীন অবস্থায় জিএসটি চালু করা, যা নানান জিনিস কেনাবেচার ব্যাপারে এতটাই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে যে প্রথম দিকটায় বেশ কিছু জরুরি পণ্য (যেমন, ওষুধ) বাজার থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। এখনও বিভ্রান্তি চলেছে, যার সবচেয়ে বড় শিকার ২-১০ কোটি পুঁজির ছোট-মাঝারি শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা, যাঁরা বিজেপির অন্যতম সমর্থনভিত্তি। এঁরা কিন্তু ফুঁসছেন।
অন্য দিকে, নিত্যদিন স্থায়ী আমানতে সুদ কমতে থাকায় দেশ জুড়ে বয়স্ক মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠেছে। গুজরাতে নির্বাচনী সফরে রাহুল গাঁধী সমাজের নানা অংশের পাশাপাশি এই জিএসটি-আক্রান্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের ক্ষোভের কথা শুনেছেন। এর পাশাপাশি অল্পেশ ঠাকোরে, জিগ্নেশ মেহভানী আর হার্দিক পটেলদের তফসিলি জাতি ও জনজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণির সামাজিক সমর্থন চাইছেন। ফল যা-ই হোক, বিজেপি এখন কিছুটা ব্যাকফুটে। একটু হলেও বিরোধীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। দুর্জনের (‘অপ’)ব্যাখ্যা, এই কারণেই ওখানে নির্বাচনের দিন ঘোষণা (‘বন্যার’ অছিলায়) বিলম্বিত হল! তবু অমিতবিক্রমে শাহ দাবি করছেন, ১৮২ সদস্যের বিধানসভায় তাঁরাই ১৫০ আসন পাবেন। যদি তার থেকে খান-পাঁচ কম পান, তবুও রক্ষে। যদি সংখ্যাটা আরও ২৫-৩০ কমে যায়, তবে সরকার বিজেপি গড়বে ঠিকই, কিন্তু দল ও তার নেতাটির প্রতিষ্ঠা কিছুটা হলেও টাল খাবে।
ভারতীয় জনতা পার্টি এবং তার সর্বশক্তিমান নায়কের পক্ষে, সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়!
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy