এই দল ছেড়ে ওই দলে, রাজনৈতিক নেতাদের ভোলবদলের ধুম। সঙ্গে জোরকদমে আসন্ন নির্বাচনের বিশ্লেষণ— কে কোন রাজনৈতিক ডাঙায় উঠবে, কার সঙ্গে কার গাঁটছড়া মোটে সম্ভব নয়। ভোটাভুটির গণতন্ত্র, সংখ্যাগুরুত্বের প্যাঁচ-পয়জার নিয়ে আলোচনার সুবিধে, এতে বিভিন্ন দলের গতিপ্রকৃতি নিয়ে অক্লেশে রায় দেওয়া যায়, নিজের দায়বদ্ধতার চাপ নেই। কিন্তু গণতন্ত্র কি কেবল নির্বাচনে সীমাবদ্ধ, না কি তার একটা ব্যাপকতর দাবি রয়েছে আমার আপনার উপর, আমাদের সম্মিলিত তথ্যনির্ভর আলোচনার কর্তব্যের উপর? সেই বিবেচনার গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনী ফলাফল, ক্ষমতা ও কৌশলের রাজনীতিতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে না, প্রশ্ন তোলে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের। দলাদলির রোজনামচা থেকে আলোচনার অভিমুখ ঘুরিয়ে চোখ রাখতে হয় নিজের উপর। আত্মজিজ্ঞাসু আমরা প্রশ্ন করছি, আমাদের প্রতিবাদ, প্রতিপ্রশ্ন, শঙ্কা কোন রাজনীতির বিরুদ্ধে এবং কেন? নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, আমার আপনার রাজনৈতিক অবস্থানটা কী? নাগরিক হিসাবে এই নৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার দায় আমরা ‘সেফোলজি’-র আড়ালে এড়িয়ে যেতে পারি না।
রাজনীতিতে আবার নীতিকথা কেন? অস্কার ওয়াইল্ড তো বলেইছেন, সমাজ ও গণতন্ত্রের ভালমন্দ নিয়ে ভাবনাচিন্তায় বহু সন্ধে নষ্ট হয়ে যায়, যখন নিজের সুখ, বিনোদন বা দুশ্চিন্তা নিয়ে কাটানো যেত। এই তির্যক মন্তব্যের মধ্যেও কিন্তু সেই মূল্যবোধ ও চেতনার উত্তরণের ডাক। অধ্যাপক পল ব্লুম তাঁর সাড়া জাগানো বই জাস্ট বেবিস-এ মনোবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও দর্শনের আলোয় ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষের মধ্যে এক সহজাত নৈতিকতাবোধের কথা। হাঁটতে বা কথা বলতে শেখেনি এমন শিশুর মধ্যেও নিজের ভুল হলে অপরাধবোধ, অন্যের দোষ হলে ন্যায্য উষ্মার প্রবণতা দেখা গেছে। তবে এই ভালমন্দের বোধ সীমিত, ঠিকমতো লালিত না হলে তা গোঁড়ামিতে পর্যবসিত হতে পারে। যুক্তি তর্ক ও তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনার মুক্তধারায় আমাদের বিচার-বিবেচনা সিঞ্চিত করলে তবেই সেই জন্মগত মূল্যবোধের বীজ প্রাপ্তবয়সে বিকশিত হতে পারে। আজ তাই গণ-আলোচনা ও যুক্তি-তর্কের নিয়ত অনুশীলনে নাগরিক হিসাবে ভালমন্দের বিশ্লেষণ করার দিন।
যেমন ধরা যাক, নতুন তিনটি কৃষি আইন রদের দাবিতে ও ন্যূনতম ফসলের দামের স্বীকৃতি চেয়ে কৃষিজীবীদের যে আন্দোলন চলছে, সে ব্যাপারে আমার আপনার ভাবনা কী? সরকারি বা বেসরকারি কৃষি বাজারের ভালমন্দ, চুক্তি চাষের খুঁটিনাটি সবাই হয়তো যথার্থ অনুধাবনের ধৈর্য রাখতে পারব না। কিন্তু এই আন্দোলনের মূলে প্রোথিত যে আশঙ্কা তা হল প্রায় নিঃশব্দে, বিনা আলোচনায় কৃষিব্যবস্থার চরিত্রগত পরিবর্তনের অভিপ্রায়; ক্ষুদ্র, মধ্য ও বড় কৃষিজীবীর হাত থেকে উৎপাদনের রাশ আলগা করে কর্পোরেট-চাষ প্রণয়ন। সঙ্গে জড়িয়ে জমির অধিকারের প্রশ্নও। ইতিমধ্যেই সারা দেশের প্রাকৃতিক ও খনিজ তেল ও সম্পদের সিংহভাগ কয়েকটি পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তাই কৃষিজীবীদের দুশ্চিন্তা নিয়ে আমাদেরও চিন্তার কারণ আছে বইকি। ধনতন্ত্রের দাপটে বিশ্বে কৃষিব্যবস্থার সঙ্কট আজ স্পষ্ট, মানুষের খাদ্য সুরক্ষা ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব বিপন্ন, তার অশনি সঙ্কেত আমাদের সমাজে যেমন নির্মম ভাবে ঘোষিত হচ্ছে, তা কি আমাদের রাজনৈতিক বিবেচনার আড়ালে থেকে যাবে? না কি উদাসীন থাকব এই তথ্যেও— বিশ্বে পুষ্টির নিরিখে এ বছর আমাদের স্থান বড়ই নীচে?
ইদানীং কালের রাজনীতিতে নীতিকথার প্রসঙ্গটি ওঠে শ্রমজীবীদের ক্ষেত্রেও। নির্বাচনের আসরে তা নিয়ে মাথাব্যথা যদি না-ও দেখি, গণ-আলোচনার পরিসরে তার চর্চা আমার-আপনার অধিকার ও দায়িত্ব। আচমকা লকডাউনে কত পরিযায়ী ও অসংগঠিত কর্মী পথে নামতে বাধ্য হয়েছেন, তা আমরা দেখেছি। প্রায় নিঃশব্দে চলেছে আর একটি প্রক্রিয়া, বিবিধ অধ্যাদেশের মাধ্যমে বা আইন রদবদল করে নানা শ্রম আইনকে নিস্তেজ ও নিষ্ক্রিয় করে ফেলার পদক্ষেপ, বিনিয়োগকারীর স্বার্থরক্ষায় শ্রমিকের ন্যূনতম দাবিদাওয়া একেবারে বিলোপ না করলেও যাতে নিতান্ত কমজোরি করে দেওয়া যায়। সম্প্রতি কর্নাটকের আইফোন কারখানায় যে কর্মী বিক্ষোভ দেখা গেল তা শ্রম সুরক্ষা আইনকে নখদন্তহীন করার বিরুদ্ধে তাঁদের নিরুপায় প্রতিবাদ— আধা বেতন, দেরিতে বেতন, ওভারটাইমের পারিশ্রমিক না দেওয়া, সর্বোপরি কাজের সময় ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা করে দেওয়ার মতো অন্যায্য সব কারবার, আইন যার বিরুদ্ধে নীরব। যে কারখানায় ৪৪৫টা সিসিটিভি ক্যামেরায় কর্মীদের নিরন্তর নজরদারি করা হয়, সেই কারখানা লকডাউনের কোনও কোনও মাসে কিছু কর্মীকে বেতন দিয়েছে মোটে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা। তাঁদের ছেলেমেয়েরা আজ শিশু শ্রমিক। শ্রমিকের অধিকার জলাঞ্জলি দেওয়ার এই রাজনীতি কি আমাদের গণতান্ত্রিক চেতনাকে অসহিষ্ণু করে তুলবে না?
কে নাগরিক, তা নিয়েই পাশ হয়েছে আইন, যা ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনরেখা টেনে, নিজভূমে ‘দ্বিতীয় শ্রেণি’র নাগরিক বানিয়েছে বহু মানুষকে। এই বিভাজন ও বহিষ্কারের রাজনীতি দিয়ে আমরা কি সকলের গণতন্ত্র গড়তে পারব? অমর্ত্য সেন বলেছেন, এ শুধু একনায়কের একার নিয়ন্ত্রণে চালিত যুদ্ধ নয়, কী করণীয় তা নিয়ে চাই সবার সম্মিলিত প্রস্তাব ও প্রয়াস।
অনেকে বলছেন, আসন্ন নির্বাচনে হতাশাব্যঞ্জক ফলের জন্য তাঁরা এখন থেকে তৈরি হচ্ছেন। এ এক ধরনের রাজনৈতিক অলসতার লক্ষণ, কারণ এখানে কোনও আত্মসমীক্ষা বা জিজ্ঞাসা নেই। অথচ দেশের নানা প্রান্তে সমাজমনস্ক, সংবিধান-বান্ধব ব্যক্তি থেকে তরুণ ছাত্রদল মূল্যবোধের, নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্ন তুলছেন। প্রশ্ন তোলার, নিজেকে প্রশ্ন করার দিন আজ। ভুলে যাওয়া যাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy