ফাইল চিত্র।
হাওড়া থেকে হুগলি, পুরো রেলপথের দু’ধারে সে দিন কাতারে কাতারে লোক। সবাই এসেছে একটা অদ্ভুত ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে। আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিনটি তখনও কালের গর্ভে। কিন্তু সে দিনটাও ছিল ১৫ অগস্ট। সাল ১৮৫৪।
লাইনের ধারে খুব বেশিক্ষণ কিন্তু অপেক্ষা করতে হল না মানুষগুলোকে। সকাল হওয়ার কিছু পরেই ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে এল এক অতিকায় যন্ত্রদানব। সকলে বিস্মিত। ভয়ে অনেকে সরেও গেল দূরে। এ ভাবেই সে দিন বাংলাদেশে ঘটে গেল এক যুগান্তকারী ঘটনা। চলল রেলগাড়ি। প্রথম।
এ দেশে প্রথম রেলগাড়ি চালু হয় ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল। বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত সেই রেলপথের দূরত্ব ছিল ২১ মাইল। তার এক বছর কয়েক মাসের মধ্যেই এখানেও তা চালু হয়ে গেল। হাওড়া থেকে লাইন পাতা হয়েছিল পান্ডুয়া পর্যন্ত। কিন্তু ঠিক হল প্রথমে ট্রেন চলবে হুগলি পর্যন্ত। ক’দিন পরে যাবে পান্ডুয়ায়। ১৫ অগস্ট হাওড়া ও হুগলির মধ্যে প্রথম রেলগাড়ি চালু হওয়ার কথা জানিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হল।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে হাওড়া ও হুগলিতে ট্রেন ছাড়ার সময় পাওয়া গেল। জানা গেল, ট্রেন কোন কোন স্টেশনে থামবে সেগুলোর নামও। সৌভাগ্যের অধিকারী এই স্টেশনগুলি ছিল বালি, শ্রীরামপুর এবং চন্দননগর।
হাওড়া থেকে প্রথম ট্রেনটি বিজ্ঞাপিত সময়ের দেড় ঘণ্টা আগে ৮টা ৩০ মিনিটে ছেড়ে হুগলি পৌঁছল ১০টা ০১ মিনিটে। প্রথম ট্রেনে ওঠার জন্য দরখাস্ত পড়েছিল তিন হাজার। কিন্তু জায়গা ছিল মাত্র কয়েকশো। ট্রেনে প্রথম শ্রেণির কামরা ছিল তিনটি, দ্বিতীয় শ্রেণির দুটো এবং তৃতীয় শ্রেণির তিনটি। এ ছাড়া গার্ডের জন্য ছিল একটা ব্রেক ভ্যান। প্রথমে, হুগলি পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ভাড়া ঠিক হয়েছিল চার টাকা, পরে সেটা বদলে ওই প্রথম দিন থেকেই করা হয় তিন টাকা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ভাড়া ছিল এক টাকা দু’আনা এবং সাত আনা।
বাঙালির ঝুলিতে আরও একটি নিজস্ব ১৫ অগস্ট আছে। যা নিয়ে সে গর্ব করতে পারে। ১৮৭২ সালের ১৫ অগস্ট। এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন ঋষি অরবিন্দ। ভাবলে অবাক লাগে, তার পঁচাত্তর বছর পরে একই দিনে ভারত স্বাধীন হবে। আর ১৮৭২ সালের ১৫ অগস্ট যিনি জন্মগ্রহণ করলেন তিনি সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সৈনিক!
রংপুরের জেলা সার্জন বিলাতফেরত কৃষ্ণধন ঘোষ সব রকম ভাবে চেষ্টা করেছিলেন, ছেলেদের ভারতীয় প্রভাবমুক্ত করতে। কিন্তু ভবিতব্য আলাদা। বিলেতে শিক্ষাদীক্ষা দিয়েও অরবিন্দকে বিদেশি করা গেল না। অরবিন্দ দেশে ফিরে যখন বরোদা স্টেট সার্ভিসে কর্মরত তখন তাঁকে বাংলা শেখানোর জন্য নিযুক্ত হন দীনেন্দ্রকুমার রায়। দীনেন্দ্রকুমার লিখেছেন, ‘পরিচ্ছেদের পারিপাট্যের প্রতি শ্রী অরবিন্দের কোনওদিন লক্ষ্য ছিল না। পোশাক-পরিচ্ছেদ দূরের কথা, নিত্যব্যবহার্য জুতা জামাকাপড় সম্বন্ধে এরূপ ঔদাসীন্য বিলাতফেরতদের মধ্যে আর কাহারও কখন দেখি নাই।’
দেশে পা দিয়েই অরবিন্দ ব্রিটিশ অপশাসনে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। হয়তো একেবারে সামনে থেকে নয়, কিন্তু নেপথ্যে চরমপন্থী আন্দোলনের তিনি হয়ে ওঠেন এক বড় শক্তি ও প্রেরণা। কিন্তু আলিপুর বোমা মামলায় জড়িয়ে ভাগ্যক্রমে বেকসুর খালাস পাওয়ার পরে জীবনের মোড় ঘোরে তাঁর। শুরু হয় আধ্যাত্মিক জীবন। যে আধ্যাত্মিক জীবন তাঁর উপলব্ধির আলোয় সুদূর পুদুচেরি থেকে দীর্ঘকাল অনুপ্রাণিত করে গিয়েছে বাঙালিকে।
রবীন্দ্রনাথ অরবিন্দের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝলুম ইনি আত্মাকেই সবচেয়ে সত্য করে চেয়েছেন, সত্য করে পেয়েওছেন। …আমার মন বললে ইনি অন্তরের আলো দিয়েই বাহিরে আলো জ্বালাবেন।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহো নমস্কার।’ ১৫ অগস্ট আমাদেরও তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর দিন।
অরবিন্দের প্রয়াণ হয় ১৯৫০ সালে। যদিও আধ্যাত্মিক জীবনে পার্থিব কোনও বিষয়েই তাঁর আসক্তি ছিল না। তবু তাঁর জীবদ্দশাতেই ঘটেছিল আমাদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি।
অরবিন্দের অনেক বছর পরে ১৯২৬ সালের ১৫ অগস্ট জন্মেও কিন্তু বাঙালির আর এক অহঙ্কার, সুকান্ত ভট্টাচার্যের স্বাধীনতার সাক্ষী থাকার সৌভাগ্য হয়নি। ১৯৪৭ সালের মে মাসেই তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। ফুটে ওঠার আগেই তাঁর ঝরে যাওয়া। তবু ওই বয়সেই তিনি নিজের জাত চিনিয়ে গিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘মনে মনে আমি তাকে মার্কা দিয়ে রেখেছিলুম জাত কবিদের কেলাশে; উঁচু পর্দায় আশা বেঁধেছিলুম তাকে নিয়ে।’ যক্ষ্মায় তাঁর অকাল মৃত্যুর পরে বুদ্ধদেবের আক্ষেপ যেন সমস্ত বাঙালিরই আক্ষেপ। বুদ্ধদেব লিখেছেন, ‘যে চিলকে সে ব্যঙ্গ করেছিলো সে জানতো না সে নিজেই সেই চিল; লোভী নয়, দস্যু নয়, গর্বিত নিঃসঙ্গ আকাশচারী, স্খলিত হয়ে পড়লো ফুটপাতের ভিড়ে, আর উড়তে পারলো না, উঠতেই পারলো না।’ মাত্র একুশ বছরের জীবনে সুকান্তের রেখে যাওয়া অমূল্য রচনা সম্ভার আজও বাঙালি যত্ন করে পড়ে, রস গ্রহণ করে। ১৫ অগস্ট সুকান্তকে ফিরে দেখার দিন।
১৫ অগস্ট মানেই আমাদের কাছে অনেক মিছিলের সফলতা। তবু এ বার একটা মিছিলেই চোখ রাখি। ‘বিরাট বড় একটা মিছিল… মিছিলের সামনে বড় স্বাধীন বাংলার পতাকা, সবাই শ্লোগান দিচ্ছে-জয় বাংলা। …শ্লোগানটা সাংঘাতিক। বলার সময়ই মনে হয় দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে।’ (‘আমার বন্ধু রাশেদ’/ মুহম্মদ জাফর ইকবাল)
এই ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে দিয়ে যিনি বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল কাণ্ডারী সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে নির্মমোচিত ভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
১৫ অগস্ট বাঙালির কাছে তাই অনুতাপেরও দিন। হয়তো কাঁটাতার বাঙালিকে পূর্বে-পশ্চিমে ভিন্ন করেছে। কিন্তু পুবের আকাশের ঘুড়ি পশ্চিমে তো আজও কখনও-সখনও লাট খেয়ে পড়ে! তা ছাড়া ‘আমাদের এক রবীন্দ্রনাথ, এক নজরুল’ (‘পুব-পশ্চিম’/অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত)। তাই এ পারের সুখ দোলা দেয় ওপারে, ওপারের দুঃখ এপারে বয়ে আনে বিষণ্ণতা। বাংলাদেশে ‘জাতীয় শোকের দিন’ হিসাবে চিহ্নিত ১৫ অগস্ট স্বভাবতই আমাদের মনেও জাগ্রত করে সে দিনের কিছু বিষণ্ণ আবেশ; শিক্ষা দেয় বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রতিহিংসা ইতিহাসে কখনও জয়ী হয় না, জয়ী হয় ভালবাসা, প্রেম, সৌহার্দ্য।
শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল
ঋণ— ‘কলিকাতা-দর্পণ’ প্রথম পর্ব/ রাধারমণ মিত্র
‘বুদ্ধদেব বসুর জীবন’/ সমীর সেনগুপ্ত
‘সেকালের স্মৃতি’/ দীনেন্দ্রকুমার রায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy