Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
State News

অসাম্প্রদায়িকতা বোঝাতে শুধু বাংলা-বাংলা করবেন না দোহাই

রাজ্যের বা দেশের বা পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই সাম্প্রদায়িক হিংসা কাম্য নয়। এই হিংসা মানবতার ঘোরতর অপমান। কোথাও অশান্তি চাই না, কোনও প্রান্তেই হিংসার আগুন চাই না আমরা।

টহল: পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলাকায় বাহিনী। আসানসোলে। —নিজস্ব চিত্র।

টহল: পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলাকায় বাহিনী। আসানসোলে। —নিজস্ব চিত্র।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৮ ০০:৩০
Share: Save:

বড্ড ভুল হয়ে যাচ্ছে কথায়-বার্তায়। গলদ রয়ে যাচ্ছে চৈতন্যের শিকড়েই। সমস্যাটা শিকড়ে বলেই রোগমুক্তিটা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উপরে উপরে চিকিৎসা করে লাভ খুব হবে না, গভীরে গিয়ে নিরাময় ঘটাতে হবে এই মানসিক স্থবিরতার।

সহিষ্ণুতা, উদারতা, মানবিকতা ইত্যাদি কোনও জাতির বা ভাষার বা ধর্মের বা বর্ণের ঐকান্তিক অধিকার বা পরিচিতি নয়। এই সবই আসলে সভ্যতার শিক্ষা, তথাপি প্রতিটি সভ্য মানুষের পরিচিতি, প্রতিটি সভ্য মানুষের আবশ্যিক বৈশিষ্ট। কিন্তু সে কথা আমরা মনে রাখছি না, যখন আমরা আসানসোল-রানিগঞ্জে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রেক্ষিতে উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং সভ্যতার দোহাই পেড়ে উন্মত্তদের থামতে বলছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই বার বার বলছেন, ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’, অথবা ‘এ বাংলায় এ সব হয় না’ অথবা ‘বাঙালির সংস্কৃতিতে এ সব নেই’। আমাদের প্রত্যেককে মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সব সভ্য মাটিই দুর্জয় ঘাঁটি, পৃথিবীর কোনও সভ্য প্রান্তেই এ সব হয় না, পৃথিবীর কোনও সভ্য সংস্কৃতিতেই এ সব নেই। শুধু বাংলা খুব উদার এবং সহিষ্ণু এবং মানবিক আর ভারতের অন্য নানা প্রান্ত অনুদার এবং অসহিষ্ণু এবং অমানবিক— এই ধরনের মন্তব্য বা মতামত বা ভাব প্রকাশের মধ্যেও একটা সাংঘাতিক সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে। সেটাকে আমরা চিনতে পারি না অনেকেই। নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করা অনেক বাঙালিই এই সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত। কিন্তু যে কোনও ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে সমূলে উপড়ে ফেলার সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়েছে আজ। অতএব প্রত্যেককে আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে। কণামাত্র সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্বও যদি থেকে থাকে, তারও বিনাশ ঘটাতে হবে। তা হলেই মৌলিক পরিবর্তনটা আসবে। তা হলেই এই অনর্থক এবং বর্বরোচিত অশান্তি থেকে দূরে থাকতে পারব আমরা।

উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অংশ ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখেছে গত বছরেই। হিংসা দেখেছে হাওড়া, হিংসা দেখেছে উত্তরবঙ্গের নানা এলাকা। এই প্রথম বার নয়। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক হিংসার ভয়ঙ্করতম নিদর্শন যে সব এলাকায় দেখা গিয়েছে, অবিভক্ত বাংলার নোয়াখালি তার মধ্যে অন্যতম। ১৯৪৬-এর কলকাতাও হয়ে উঠেছিল দুঃস্বপ্ন। তাই বাংলায় এ সব হয় না, বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায় না— এই জাতীয় সারবত্তাহীন মন্তব্য করে লাভ নেই। কারণ তাতে সঙ্কটমুক্তির কোনও পথ নেই। আমরা যে ভুল পথে পা বাড়াচ্ছি, সেই বার্তাটা চারিয়ে দেওয়াই সবচেয়ে জরুরি আজ। একটা বিভাজন যখন রক্তাক্ত করছে রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে, তখন বাঙালি আর অবাঙালি বা বাংলা আর না-বাংলার মধ্যে আর এক বিভাজনের তত্ত্ব সামনে আনা যে বিচক্ষণতার কাজ নয়, সে কথা বোঝা জরুরি খুবই।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

রাজ্যের বা দেশের বা পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই সাম্প্রদায়িক হিংসা কাম্য নয়। এই হিংসা মানবতার ঘোরতর অপমান। কোথাও অশান্তি চাই না, কোনও প্রান্তেই হিংসার আগুন চাই না আমরা। আসানসোল-রানিগঞ্জ যেমন হিংসা চায় না, বসিরহাট বা ধুলাগড়ও তেমনই চায় না। চায় না উত্তরপ্রদেশের মুজফ‌্ফরনগর, চায় না গুজরাতের গোধরা বা নারোদা-পাটিয়া, চায় না বিহার। সবাই শান্তিতেই বাঁচতে চান, সকলেই জীবনে সুস্থিতি চান, পারস্পরিক সম্প্রীতি চান।

আরও পড়ুন: যাত্রাভঙ্গে বচসা বাবুলে-পুলিশে

তা সত্ত্বেও অশান্তি হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার আগুন লেলিহান শিখা নিয়ে মাঝে-মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করছে। আগুনের শিখাটা লকলক করে উঠতে পারছে কারণ, সাম্প্রদায়িকতার বীজ নানা রূপে আমাদের অনেকের মধ্যেই কোথাও না কোথাও রয়ে গিয়েছে। সেই বীজই আগুনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। সেই বীজ রয়েছে বলেই ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার কারবারিরা আমাদের অনেককেই আজও ফাঁদে ফেলতে পারছে।

আরও পড়ুন: নরম পুলিশ দেখেই গরম আসানসোল

সাম্প্রদায়িকতার বা সঙ্কীর্ণতার প্রতিটি বীজকে চিহ্নিত করতে হবে, ছুড়ে ফেলতে হবে অস্তিত্বের অনেক দূরে। তার জন্য শুধু বাংলায় নয়, গোটা দেশে শান্তি বহাল রাখার তাগিদ অনুভব করতে হবে। শুধু দেশকে নিয়ে নয়, গোটা পৃথিবীকে নিয়ে ভাবতে হবে। যে দিন সে ভাবে ভাবতে পারব সবাই, সে দিন আর হয়ত দেখতে হবে না এই হিংসার পুনরাবৃত্তি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE