Advertisement
১০ জানুয়ারি ২০২৫

বাড়িতে থাকা মানে না থাকা

প্রশ্ন উঠতে পারে, আলাদা করে বাড়ির মহিলাদের কথা এই মুহূর্তে বলার কী আছে? বলার আছে। যে মহিলা (বা পুরুষ) এই গ্রীষ্মে কাজ করতে বেরোচ্ছেন তিনি কষ্টে আছেন ঠিকই, কিন্তু যে মহিলা বাড়িতে আছেন?

ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৯ ০০:৩৫
Share: Save:

ভোটের গরম কাটতে না কাটতেই তাপমাত্রা চরমে উঠেছে। তা নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। কেন গরম, কবে গরম কমবে, গরম থেকে বাঁচতে কী কী করা উচিত, এই সব নিয়ে অনেক কথা চলছে, চলবে। এটাই প্রতি বছর চলে। শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষের জন্য গরমে বিশেষ যত্ন নেওয়ার কথা বলা হয়। যাঁরা কাজ করতে বাইরে বেরোন, বলা হয় তাঁদের কথা। যাঁরা পথেঘাটে অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করতে বাধ্য হন, তাঁদের বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।

কাদের কথা বলা হয় না মোটেই? প্রান্তবাসীদের কথা তো বটেই। কিন্তু আরও একটি বর্গ আছেন, যাঁদের সংখ্যা অনেক, যাঁরা প্রান্তবাসীও নন, থাকেন সমাজের মাঝখানে, কিন্তু তাঁদের কথা মনে পড়ে না কখনওই। এই প্রবল গ্রীষ্মে তাঁরা কেমন আছেন, তাঁদের গ্লুকোজ় ওয়াটার লাগবে কি না, সে সব প্রশ্ন করে না কেউ, এমনকি ভোটের সময়েও। তাঁরা হলেন বাড়ির মহিলারা, যাঁদের হোমমেকার নামটা এত দিনে কানসওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আলাদা করে বাড়ির মহিলাদের কথা এই মুহূর্তে বলার কী আছে? বলার আছে। যে মহিলা (বা পুরুষ) এই গ্রীষ্মে কাজ করতে বেরোচ্ছেন তিনি কষ্টে আছেন ঠিকই, কিন্তু যে মহিলা বাড়িতে আছেন? যিনি প্রতি দিন অনেকটা সময় প্রবল গরমে সবার জন্য রান্না করছেন, তাঁর জন্য গ্রীষ্মের মোকাবিলার কথা অবশ্যই ভাবা দরকার। এখনও শতকরা প্রায় আশি ভাগ বাড়িতে মহিলারাই রান্না করেন, অর্থাৎ এই গরমে সবার সামনে খাবার ধরার জন্য আগুনের সামনে আধসিদ্ধ হন। গরমে তাঁরও শরীরে জলের অভাব সৃষ্টি হয়েছে কি না, কেউ জানতে চাইবেন কি? তাঁর মুখের সামনে ঠান্ডা শরবত বা ডাব ধরা প্রয়োজনীয় মনে করবেন কেউ? উল্টে, ‘রাস্তাঘাটে তো গরমে বেরোতে হয় না’, ‘দুপুরে তো ঘুমোতে পাচ্ছ’ ধরনের কথাই কমবেশি উড়ে আসে। ভোরের প্রথম চা দেওয়া এবং রাতে শেষ শুতে যাওয়ার রুটিন মেনে চলতে গেলে বাড়ির পুরুষ সদস্যটিরও দুপুরে চোখ লেগে আসত— এ কথা বাইরে থেকে তেতেপুড়ে আসা মানুষটিকে সচরাচর বলেন না উল্টো দিকে থাকা মানুষটি। কেউ কেউ হয়তো বলে ফেলেন কখনও। হয়তো কোনও ছোট ছবির প্রতিবাদী দৃশ্যে মহিলা রান্না বন্ধ করে চুপচাপ এয়ারকুলারের সামনে এসে বসেন। কিন্তু ওইটুকুই, বড় ছবিটা একই থেকে যায়।

কারণ খুঁজতে গিয়ে ঘুরেফিরে সেই একই জায়গায় আসা। বাড়ির মহিলাদের শ্রমের কানাকড়ি দাম না থাকা। এই নিয়ে কত কথা বলাবলি, কত লেখালিখি, কিন্তু অবস্থা যে কে সেই। বলা হয়, আর্থিক স্বনির্ভরতাই এই সমস্যার সমাধান। কিন্তু ব্যাপারটা কি এতই সোজা? হোমমেকারদের উপরে এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় অর্ধেক বাড়ির মহিলারাই চান কাজ করতে, আর্থিক ভাবে স্বাধীন হতে। কিন্তু চাইলেই তো হল না। বাড়ির মহিলাদের নিজের মতো কাজ করতে সাহায্য করবে কে? বহু মহিলাই পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন পুঁজির অভাবে, বাড়ির কাজের পর সময়ের অভাবে, আত্মবিশ্বাসের অভাবে।

আলাদা করে বাড়ির মহিলাদের সম্পর্কে এত কথা বলার কারণ? বাড়ি থেকে বাইরে বেরোচ্ছেন যে মহিলারা, তাঁরা কি অপেক্ষাকৃত ভাল আছেন? বাড়ির মহিলাদের কথা বার বার বলার একটা কারণ অবশ্যই তাঁদের সংখ্যাধিক্য। আমাদের দেশে আজও বাইরে কাজ করতে বেরোন মহিলাদের মাত্র সিকিভাগ, আর সন্তানের জন্মের পরেও কাজ করেন এর মধ্যে থেকে মাত্র কুড়ি শতাংশ। মহিলা শ্রমিক, মহিলা ভোটকর্মীদের সম্পর্কে, বাড়ির সহায়িকাদের সম্পর্কে সমীক্ষা হয়। কিন্তু বাড়ির মহিলাদের নিয়ে তথ্য বেশ কম, এতই তুচ্ছ বলে গণ্য হয় তাঁদের উদয়াস্ত শ্রম।

আর তাই বিশেষ করে মনে করি একটি তারিখ: ২৪ অক্টোবর ১৯৭৫। ওই দিন আইসল্যান্ডের হোমমেকাররা এক দিনের জন্য একটা বন্‌ধ বা স্ট্রাইক ডাকেন। তাঁরা ঘোষণা করেন এটি ‘উইমেনস ডে অফ’। দিনটি বিখ্যাত হয় ‘লং ফ্রাইডে’ নামে। এর ফলে সে দিন বাবারা ছেলেমেয়েদের স্কুলে বা অন্যত্র নিয়ে যেতে বাধ্য হন। সসেজ শেষ হয়ে যায় সব দোকানে। ঝাঁপ বন্ধ করতে বাধ্য হয় আইসল্যান্ডের সব ফ্যাক্টরি আর ব্যাঙ্ক। এর ফলে সরকার নড়েচড়ে বসে— এর দু’বছর পরে, অনেকাংশে এই ঘটনারই জেরে নির্বাচিত হন আইসল্যান্ডের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট ভিগদিস্‌ ফিনবগাদট্টির, যিনি ইউরোপ মহাদেশেরও প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট।

এই গ্রীষ্মে নতুন সরকার নির্বাচন করল ভারত। সেই দেশের মধ্যে তো বাড়ির মহিলারাও ছিলাম। সকাল সকাল রান্না করে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম ভোটের লাইনে।

তবু আমাদের কথা আলাদা করে বলা হল কই? গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা আসার সময় হল। সাধারণ নির্বাচন পেরিয়ে যেমন আসবে পুরভোট। কে বলবে হোমমেকারদের কথা?

অন্য বিষয়গুলি:

Summer Health Female Homemaker
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy