নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় আমরা কলেজের সিনিয়র ব্যাচের পথ ধরে গবেষণা করার অছিলায় বিদেশে গিয়েছিলাম। মা-বাবা, পাড়া-পড়শি সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন করেছিলেন, “বিদেশে যেতে হবে কেন? দেশে কি পিএইচ ডি করা যায় না?” বছর চারেক পরে যখন বিলেতের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেলাম, মন্তব্যগুলো আরও ধারালো হল, “বিদেশে পিএইচ ডি তো হল, এ বার ফিরে আয়। দেশে কি ভাল ভাল কলেজ নেই? সেখানে কি পড়ানো যায় না? গবেষণা হয় না?” এই প্রশ্নটার তখন এক কথায় উত্তর হতে পারত— “না মশাই, হয় না।”
সমস্যার লিস্ট কোথা থেকে শুরু করব? উন্নয়নশীল দেশের প্রথম আর শেষ কথাটাই হল, আমরা গরিব, আমাদের টাকা নেই। তবে, অজুহাত হিসেবে কথাটা যেন বড্ড কানে বাজে। তবু বলি, ‘টাকা নেই’ কথাটার এ ক্ষেত্রে দুটো অর্থ ছিল। প্রথমত, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকদের মাইনে গত শতকের শেষেও সত্যিই খুব কম ছিল। দ্বিতীয়ত, গবেষণার জন্য, বিশেষত বিজ্ঞানে গবেষণা করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য সরকারি কোনও অনুদান ছিল অপ্রতুল। তা ছাড়া, প্রাক্-মনমোহন দেশের অর্থনীতিও ছিল আজকের থেকে অনেক আলাদা। মনে পড়ে, বিদেশে যাওয়ার আগে পকেটের বিদেশি মুদ্রার পরিমাণটা অবধি পাসপোর্টে লিখিয়ে নিয়ে যেতে হত। সেই বদ্ধ অর্থনীতি ও পরিবেশে টাকা থাকলেও, লালফিতের চাপে একা কোনও গবেষক বা গবেষণা কেন্দ্রের পক্ষে বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাল মিলিয়ে যৌথ ভাবে গবেষণা করা প্রায় একটা অসম্ভব কাজ ছিল। সেই আমলের গবেষকমাত্রই জানেন কথাটা।
অনেকে হয়তো সত্তর-আশির দশকের বাম-নেতাদের মতো বলবেন, “এত বিদেশ-বিদেশ করে লাফানোর কী আছে? বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে কি গবেষক হওয়া যায় না?” স্বীকৃতি বা পুরস্কারের জন্য নয়, উন্নত মানের গবেষণার খাতিরেই দেশ-বিদেশে যোগাযোগ প্রয়োজন। উনিশ শতকের ইংরেজি শিক্ষা অথবা গত শতাব্দীর ঔপনিবেশিক ‘হ্যাংওভার’ থেকে এই মত গড়ে ওঠেনি। ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ ইয়েটস-এর দেখা, রামানুজনের নিজের হাতে হার্ডিকে চিঠি লেখা, বা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পেপার আইনস্টাইনকে পাঠানো নিশ্চয় এই মতের পক্ষে যাবে। অমর্ত্য সেন আর অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল জয় হয়তো এই বিশ্বাসকে আরও জোরালো করেছে। কলকাতার কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে তাঁরা কি এই সম্মান পেতেন?
অবশেষে, বিশ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই আমাদের বাজার মুক্ত হল। ইউজিসি-র কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার টাকা এল, অধ্যাপকদের মাইনে বাড়ল। এখন আমরা সহজেই বিদেশের কনফারেন্সে যেতে পারি, বিদেশ থেকে সহ-গবেষককে এখানে নিয়ে আসতে পারি, সরকারের টাকায় বড় হোটেলে কনফারেন্সের শেষে ভোজের আয়োজন করতে পারি। তিন দশক পরে আর যাই হোক, ‘টাকা নেই তাই উচ্চমানের গবেষণা হবে না’— এই অজুহাতটা আজকাল আর খাটে না।
তিন দশক আগে আরও চিন্তা ছিল। আমার মতো অনেকেরই, হয়তো বা অধিকাংশেরই ‘চাকরি নেই তো গবেষণা করো’ গোছের অবস্থা ছিল। এখন সেটাও সমস্যা নয়। মুম্বই, দিল্লি, পুণে তো বটেই, এমনকি কলকাতাতেও কর্পোরেট চাকরি মেলে। উল্টে পিএইচ ডি করার জন্যই ভাল ছাত্র মেলে না।
শুধু অর্থ নয়, নতুন শতকে সুযোগ, সুবিধা, স্বাচ্ছন্দ্যও এসেছে গবেষকের জীবনে। যে শহরে এক দিন বিদেশি জার্নাল পেতে আলিপুর থেকে ডানলপ সমানে চক্কর খেতে হত, সেই শহরেই এখন ব্রডব্যান্ড দিয়ে বিশ্বের যে কোনও ডিসকাশন পেপার ঘরে বসে পড়া যায়। দুই দেশে কাজ করার সূত্রে দেখেছি, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের অফিসে এসি, বড় কম্পিউটার স্ক্রিন, প্রিন্টার। অফিসের সুখ বিলেতের অফিসের চেয়ে বেশি বই কম নয়। ফ্যাক্স, ইমেল, ফোনের যুগ পেরিয়ে আমরা এখন ভিডিয়ো কল করি। একত্রে গবেষণার কাজ করতে বিদেশে বা দিল্লিতে ছোটার আর দরকারই নেই।
তবু, কেন জানি না, এই শহরে, এই দেশে বসে নিজেকে গবেষক হিসেবে একা মনে হত। বিদেশের প্রতিটি বিভাগে প্রতি সপ্তাহে একাধিক সেমিনার হয়। গবেষণার গর্ভগৃহ সেটাই। এখানে কোনও দুরূহ তত্ত্ব আলোচনা করার মতো কেউ আমার পাশে নেই, থাকলেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে, এক জন পুণেতে, দু’জন বেঙ্গালুরুতে, তিন জন দিল্লিতে। অথবা ভাগ্যবলে এক জন শহরে থাকলেও তিনি উত্তর প্রান্তে আর আমি দক্ষিণে, যাতায়াতে দুই-দুই চার ঘণ্টা।
এইখানেই এল একটা আশ্চর্য পরিবর্তন, একটা আশ্চর্য বিপন্ন সময়ের হাত ধরে। লকডাউনের মধ্যে গত দু’মাস ধরে অনলাইনে অনেক সেমিনার শুনছি, যার পোশাকি নাম ওয়েবিনার। ভৌগোলিক দূরত্ব পুরোই ঘুচল এ বারে। হয়তো উদ্যোক্তা দিল্লিতে, হোতা আমেরিকায়, বক্তা ফ্রান্সে— আমি শ্রোতা হিসেবে বসে আছি আমার বার্মিংহামের বাড়ির খাবার টেবিলে! এক ধরনের ওয়েবিনার হল সভা-সমাবেশের পাবলিক লেকচারের মতো। দূর থেকে দেখা, টিভিতে সম্প্রচারের মতো। অন্যটা পুরোদস্তুর অ্যাকাডেমিক গবেষণার আলোচনা— তর্ক, প্রশ্নোত্তর পর্বই সেখানে মুখ্য। দেশ-বিদেশের সেরা গবেষকদের আলোচনা নিজেরা শুনে শিখতে পারছি, নিজের ঘরে বসেই তার চর্চা করতে পারছি।
করোনাভাইরাসের ভয় এক দিন চলে যাবে, লকডাউনও উঠে যাবে, কিন্তু আশা করি এই ওয়েবিনার বস্তুটি করোনা-পর্বের পরেও থাকবে। বিভাগীয় সেমিনার তা হলে কলকাতায় বসেই আয়োজন সম্ভব হল, করোনাভাইরাসের ধাক্কায় অজুহাতের শেষ দুর্গেরও পতন ঘটল।
অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy