কর্পোরেটকে কর ছাড় দিলে দেশের বৃদ্ধির হার বাড়বে, এই কথাটা অনেকখানি জ্যোতিষের আংটি ধারণ করার মতো— বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে রিসেশন। বিশ্বাসটা যে একেবারে ভিত্তিহীন, বলা যাবে না। বাজার অর্থনীতির তত্ত্বে এই বিশ্বাসের যুক্তি স্পষ্ট বলা আছে। লাভের ওপর যদি করের পরিমাণ কমে, তা হলে সংস্থাগুলোর হাতে লাভের পরিমাণ বাড়বে। আর, বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ভর করে লাভের প্রত্যাশার ওপর। অর্থাৎ, এই বাজারে আজ ১০০ টাকা লগ্নি করলে ভবিষ্যতে তার থেকে কত টাকা লাভ পাওয়া যেতে পারে, সেটাই ঠিক করে দেয়, বিনিয়োগকারী বাজারে টাকা ঢালবেন কি না। লাভের পরিমাণ এবং প্রত্যাশা বাড়া মানেই লগ্নির পরিমাণও বাড়া— সরকার অন্তত তেমনটাই বিশ্বাস করে। আর, লগ্নি বাড়া মানেই জাতীয় আয়ও বাড়া। সহজ হিসেব।
তবে, নির্মলা সীতারামন কর্পোরেট ট্যাক্স বা মুনাফা করে ছাড় দিয়েছেন বলেই জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারও বাড়তে থাকবে, সেই নিশ্চয়তা মোটেও নেই। মুনাফা নেই বলে লগ্নি নেই, না কি বাজারে চাহিদার অভাবের কারণেই শিল্পসংস্থার গুদামে বিক্রি না হওয়া পণ্য জমছে আর তাই নতুন বিনিয়োগের কারণ থাকছে না— এই প্রশ্নের ফয়সলা হয়নি মোটেও। বরং, যেটুকু হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিই সত্যি বলে মনে হয়। সে ক্ষেত্রে, করের পরিমাণ কমলেও লগ্নির পরিমাণ বাড়বে না বলেই আশঙ্কা, ফলে বাকি গল্পটাও নেই। আবার, এম গোবিন্দরাও-সহ একাধিক অর্থনীতিবিদ সংশয় প্রকাশ করেছেন— মন্ত্রীর ঘোষণায় করের হার যতখানি শোনাচ্ছে, সত্যিই কি ততটা কমল? মোট ছাড়ের পরিমাণ কি আদৌ এক লক্ষ ছেচল্লিশ হাজার কোটি টাকা, না কি মেরেকেটে তার তিন ভাগের এক ভাগ? করের পরিমাণ যদি সত্যিই না কমে, তা হলেও বাকি গল্পটা নেই।
এই আশঙ্কাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কথাগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি। কিন্তু, আরও একটা জরুরি প্রশ্ন গোলেমালে হারিয়ে যাচ্ছে। সেটা হল, ডুবন্ত অর্থনীতিকে বাঁচানোর পথ কিন্তু একটামাত্র নয়। অর্থনীতির স্বাস্থ্যোদ্ধারে সরকার যদি টাকা খরচ করে, অথবা করের পরিমাণ কমিয়ে রাজস্ব ছাড় দেয় (সেটাও খরচই, কারণ সেই রাজস্ব এলে সেটাকে খরচ করা যেত)— সেটা কোন পথে করবে? কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটকে ছাড় দেওয়ার পথে হেঁটেছে। তার বদলে, কর্পোরেটের থেকে এই করের টাকা নিয়ে তা খরচ করা যেত বিভিন্ন সামাজিক খাতে। অথবা, একই অর্থমূল্যের কর ছাড় দেওয়া যেত জিএসটিতে। কোন পথটা বাছা হবে, আর কোনটা হবে না, সেই প্রশ্নের উত্তর যতখানি অর্থনীতির, তার চেয়ে ঢের বেশি রাজনীতির।
জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার বাড়ানোই যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে কর ছাড় দেওয়ার চেয়ে সরাসরি টাকা খরচ করাই ভাল, কারণ দ্বিতীয় পথটিতে প্রতি এক টাকা ব্যয়ে জাতীয় আয়ের পরিমাণ প্রথম পথের তুলনায় বেশি বাড়ে। কথাটা নতুন নয়, গোপনও নয়— আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের গবেষণাতেই এই কথাটা স্বীকৃত। কাজেই, শুধু জাতীয় আয় বাড়াতে চাইলেও কর ছাড় দেওয়া ঠিক কাজ নয়। কিন্তু, দেড় লক্ষ কোটি টাকা খরচ করতে হলে আরও কয়েকটা কথা ভাবতে হয় বইকি। যেমন, আর্থিক মন্দার প্রথম ধাক্কাটা এসে লাগে অসংগঠিত ক্ষেত্রের অদক্ষ শ্রমিকদের ওপর। তাদের চাকরি যাওয়া সবচেয়ে সহজ। দেড় লক্ষ কোটি টাকার একটা বড় অংশ— অসীম দাশগুপ্তর হিসেবে অবশ্য বড় অংশও নয়, ২৮,০০০ কোটি টাকা— যদি কর্মসংস্থান যোজনায় যেত, তা হলে এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের কাজ জুটত। তাঁদের হাতে খরচ করার মতো টাকা আসত। সেই খরচে অর্থনীতিরও বিপুল উপকার হত— কিন্তু, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, পরিবারগুলো খেয়েপরে বাঁচত। গত কয়েক বছরে কর্মসংস্থান যোজনায় অর্থবরাদ্দ বেড়েছে নামমাত্র, এবং কার্যত কমে গিয়েছে বিভিন্ন প্রকল্পে আসা টাকার পরিমাণ। ফলে, লোকে কাজ চেয়েও পাচ্ছে না। এই ছবিটা বদলে দেওয়ার কথা অর্থমন্ত্রী ভাবলেন না।
অথবা, কর্পোরেট করের বদলে জিএসটি-র হার কমানো যেত। পরোক্ষ করের চরিত্রদোষ হল, তা ধনী-দরিদ্রে বিভেদ করে না— সবাইকে সমান হারে কর দিতে হয়। দেশের সরকার গরিব মানুষের কথা ভাবলে পরোক্ষ করের হার কমায়। কেন্দ্রীয় সরকার সে পথেও হাঁটেনি। অবশ্য, জিএসটি-র হার কমাতে সম্ভবত রাজি হত না রাজ্যগুলোও, কারণ তাতে রাজ্যের পকেটেও টান পড়ত। জিএসটি কমলে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার কতখানি বাড়ত, সেই প্রশ্নের উত্তর অস্পষ্ট— ঠিক যেমন, কর্পোরেট করের হার কমলে জিডিপি-র ওপর কী প্রভাব পড়বে, নির্মলা সীতারামনরা জানেন না। কিন্তু, এটুকু স্পষ্ট, কর্পোরেট কর কমলে প্রত্যক্ষ লাভ পুঁজিপতিদের, জিএসটি কমলে স্বস্তি সাধারণ মানুষের। কেন্দ্রীয় সরকার কাদের স্বার্থরক্ষা করতে চেয়েছে, তা নিয়ে সংশয় নেই।
ভারতে আর্থিক অসাম্য খুবই বেশি, এবং তা ক্রমশ বাড়ছে। পুনরজিৎ রায়চৌধুরী সেই অসাম্যের চরিত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন (‘বৈষম্যে বসতে লক্ষ্মী?’, আবাপ ২৩-৯)। দেড় লক্ষ কোটি টাকা এমন ভাবে খরচ করা যেত, যাতে সেই অসাম্য খানিক হলেও কমে। তার বদলে কেন্দ্রীয় সরকার বেছে নিল ট্রিক্ল ডাউন অর্থনীতির পথ— অর্থাৎ, ধনীতমদের আরও বেশি ধনী হয়ে উঠতে দেওয়া, এবং অপেক্ষা করা, বাজারের ধর্ম মেনে তাঁদের সেই সমৃদ্ধি কবে আম আদমির ঘরেও চুঁইয়ে নামবে। আসলে যে সে সমৃদ্ধি কখনও রামা কৈবর্তের ঘরে পৌঁছয় না, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে— ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার যখন সর্বোচ্চ স্তরে ছিল, তখনই অসাম্য বেড়েছিল চড়চড়িয়ে। এ বার ব্যতিক্রম হবে, ভাবার কারণ নেই।
তবুও নির্মলা সীতারামনরা নির্দ্বিধায় কর্পোরেট করে ছাড় দিতে পারেন। যাঁদের আয় দেশে সবচেয়ে বেশি, তাঁদের জন্য আরও এক দফা বাড়তি সুবিধা। কারণ, নির্মলারা জানেন, অর্থনীতির মধ্যে রাজনীতির এই খেলা নিয়ে আপত্তি করার মতো সময় বিরোধীদের নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy