‘মিনার্ভা’ প্রেক্ষাগৃহে রুক্মিণী মৈত্র। — নিজস্ব চিত্র।
দেবকে কবে বিয়ে করবেন? দেব কি তাঁকে বিনোদিনী বলে ডাকছেন? দেবের সঙ্গে কোথায় বেড়াতে যাবেন? এই সব একঘেয়ে প্রশ্ন থেকে বেরিয়ে তাঁকে জানতে চেয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন। তিনি রুক্মিণী মৈত্র। আর এই জানতে চাওয়ার কারণ নটী বিনোদিনী, আত্মত্যাগ ও অভিমান, সাফল্য আর আত্মধিক্কারের প্রতিশব্দ তিনি।
‘‘ঠাকুর আজ কলিকাতায় স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলা দেখিতে যাইবেন।... কোনখানে বসিলে ভাল দেখা যায়, সেই কথা হইতেছে। কেউ কেউ বললেন, এক টাকার সিটে বসলে বেশ দেখা যায়। রাম বললেন, কেন, উনি বক্সে বসবেন।’’
মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত তথা শ্রীম-র লেখা ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’তে ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৪ তারিখের দিনবর্ণনায় লেখা আছে এই ঘটনা। সেই বিনোদিনী বা আজকের রুক্মিণী মৈত্রকে আনন্দবাজার অনলাইন নিয়ে গিয়েছিল পুরনো থিয়েটার পাড়ায়। অর্ধেক দিন তিনি দিলেন আনন্দবাজার অনলাইনকে। ঠিক হল, দেখা হবে পুরনো থিয়েটার পাড়ার কয়েকটা পথ। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সহাবস্থানে কয়েক ঘণ্টায় রুক্মিণীও যেন নিজেকে আবিষ্কার করলেন নতুন ভাবে।
দেখা হল ‘স্টার’-এ
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে এগারোটা। প্রেক্ষাগৃহের সামনে সাদা গাড়ি এসে থামল। জানলার কালো কাচ নামতেই এক বার দেখে নিলেন প্রেক্ষাগৃহের বাইরে সদ্য ঝোলানো ‘বিনোদিনী থিয়েটার’ বোর্ডটিকে। গাড়ি থেকে নামতেই কৌতূহলী পথচারীদের ভিড়। তাঁদের উদ্দেশে এক বার হাত নেড়েই হাঁটতে শুরু করলেন অভিনেত্রী। তাঁর পরনে চন্দনরঙা জরির কাজের সালোয়ার-কামিজ। ভিতরে তখন দেব অভিনীত ‘খাদান’-এর শো চলছে। প্রেক্ষাগৃহের ছাদে বিনোদিনী মিউজ়িয়ামের সামনের সিঁড়িতে বসে পড়লেন রুক্মিণী।
কে এই বিনোদিনী? পিতৃপরিচয়হীন, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা না জানা এক নাবালিকা মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধুর মতো ধ্রুপদী লেখকদের সৃষ্টিকে উনিশ শতকের কলকাতার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন থিয়েটারের বিনোদিনী। ‘‘বিনোদিনী মানে আগুন। কেরিয়ারের দু’বছরের মাথায় এ রকম একটা চরিত্রকে না বলার কোনও কারণ ছিল না। ইন্ডাস্ট্রিতে দু’দিনের পুরনো কোনও অভিনেত্রীকে প্রস্তাব দিলেও তিনিও হয়তো রাজি হয়ে যেতেন’’, শিহরন রুক্মিণীর গলায়।
শুরুর লড়াই
পাঁচ বছর ধরে এই ছবির জন্য রুক্মিণীকে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। মুম্বইয়ের প্রযোজক সরে দঁড়ানো থেকে শুরু করে অতিমারির সময়কাল। রুক্মিণীর স্বীকারোক্তি, ‘‘আমাকে এ রকমও বলা হয়, গিরিশ এবং বিনোদিনীকে নিয়ে ছবি করতে। তা হলে নাকি নায়ক থাকবে ছবিতে! রামের (পরিচালক রাম কমল মুখোপাধ্যায়) যুক্তি ছিল, ‘নায়ক তো রয়েইছে—রুক্মিণী, বিনোদিনী’।’’ প্রতিকূলতাকে জয় করে ছবি মুক্তিকে বিনোদিনীর আশীর্বাদ বলেই উল্লেখ করলেন রুক্মিণী। তবে কি তাঁর ভিতরে এখন বিনোদিনী বাস করেন? হাসিতে মিলিয়ে গেল সমর্থনের উত্তর। শোনা যায়, এই স্টার থিয়েটারে অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার পরে বিনোদিনী লুকিয়ে চাদরে শরীর জড়িয়ে আসতেন। তখন তাঁর চেহারায় নাকি শ্বেতির দাগ।
বিনোদিনীর অভিশাপ!
কথিত আছে, বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটার থেকে বিনোদিনীকে বঞ্চিত করা হয়। তাই তিনি নাকি অভিশাপ দেন। আর তার ফলেই সেই প্রেক্ষাগৃহ আগুনে ভস্মীভূত হয়। এই ঘটনার ঐতিহাসিক সত্য নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ না করে রুক্মিণী শোনালেন তাঁর শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা। তিনি বললেন, ‘‘ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়োয় আমাদের শুটিং শেষ। তার এক মাস পর সেই সেটেও আগুন লাগে। সেই অংশে আর হয়তো কেউ কোনও দিন শুটিং করতে পারবেন না। ভিডিয়োটা আমার কাছে রয়েছে! সেই আবার আগুনের ঘটনা! কী অদ্ভুত না?’’ তবে অভিনেত্রীর বিশ্বাস, ১৪১ বছর পর ‘স্টার থিয়েটার’-এর নাম পরিবর্তনের ফলে বিনোদিনী সম্মানিত। তাই ‘অভিশাপ’ও হয়তো তিনি ফিরিয়ে নেবেন।
গন্তব্য মির্নাভা
মিনার্ভা প্রেক্ষাগৃহে গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁর জীবনের শেষ অভিনয় করেন। তাই স্টারের পর মিনার্ভার পথে স্মৃতিমেদুর রুক্মিণী। দূরত্ব খুব বেশি নয়। পৌঁছনোর পর গাড়ি থেকে নেমে মূল ভবনকে জরিপ করলেন অভিনেত্রী। তাঁকে দেখে ভিড় জমতে শুরু করেছে। প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশের আগে বাঁ দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলেন রুক্মিণী। এক ঝাঁক পায়রা রাস্তায়। কাছ থেকে তাদের দেখেই প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করলেন রুক্মিণী। প্রবেশপথের দেওয়ালে টাঙানো গিরিশচন্দ্রের ছবিতে প্রণাম করতে ভুললেন না। তিনি সম্ভবত জানেন, গিরিশচন্দ্রের কাছে লেখাপড়ার চেয়েও যে নতুন বোধে নিজেকে গড়ে নিয়েছিলেন বিনোদিনী, সেই বোধের নাম কল্পনা।
নাটকের পাশে রুক্মিণী
মিনার্ভার মঞ্চে একটি দলের মহড়া চলছে তখন। কিন্তু নাটকের দলের সদস্যেরা রুক্মিণীকে দেখেই উচ্ছ্বসিত। এক সদস্য তো বলেই দিলেন, ‘‘ছবিটার কথা জানি। মিনার্ভায় ওঁকে (বিনোদিনী) নিয়ে আলোচনা হবে জেনে আমাদেরই ভাল লাগছে।’’ মহড়া দেখতে দেখতে মঞ্চের নীচে দাঁড়িয়েই শুরু হল কথোপকথন। উত্তর কলকাতার থিয়েটার পাড়ার জৌলুস সময়ের সঙ্গে কমেছে। প্রশ্ন ছিল, দেব আর রুক্মিণী মিলে কি হারিয়ে যাওয়া নাটকপাড়াকে বর্ণময় করে তুলবেন?
তিনি বললেন, ‘‘ছবির ট্রেলার প্রকাশের পর এই প্রজন্মের অনেকেই বিনোদিনীকে চিনছেন। প্রশ্ন করছেন। এই সচেতনতা আমার বেশ ভাল লাগছে।’’ একই সঙ্গে যোগ করলেন, ‘‘এই ছবি দেখার পর নাটক নিয়ে দর্শকের উৎসাহ বাড়লে বা তাঁরা যদি মঞ্চে বেশি করে নাটক দেখেন, তার থেকে ভাল আর কী-ই বা হতে পারে।’’
প্রিমিয়ার ‘স্টার’-এ
রুক্মিণী জানালেন, এই ছবির প্রিমিয়ার তিনি ‘স্টার’-এই করবেন। সেটাও বিনোদিনীর প্রতি তাঁর এক প্রকার শ্রদ্ধার্ঘ্য। সেই সঙ্গে বাংলা নাট্যজগতের বিশিষ্টদেরও ছবিটি দেখানোর ইচ্ছা রয়েছে অভিনেত্রীর। তাঁর কথায় উঠে এল, ‘‘ব্রাত্যদা (ব্রাত্য বসু), কৌশিকদার (কৌশিক সেন) মতো অনেকেই ছবির ট্রেলার দেখে প্রশংসা করেছেন। আরও অনেকের প্রতিক্রিয়া জানার অপেক্ষায় রয়েছি।’’ তবে আলাদা করে উল্লেখ করলেন খেয়ালি দস্তিদারের কথা। রক্মিণীর কথায়, ‘‘আমি জানতাম না, দিদির বাড়িতে বিনোদিনীর মূর্তি রয়েছে। ফোনে ঝরঝর করে কেঁদেছিলেন। এখনও আমার সেই দিনটা মনে আছে।’’
সফল মহিলাদের সাফল্য অনেক সময়েই তাঁর পুরুষ সঙ্গীর পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ হয় না। বিনোদিনী তাঁর অন্যতম উদাহরণ। তিনি প্রেম খুঁজে বেড়ালেন, প্রেম পেলেন না। আজকের সমাজেও কি এই ধারণার কোনও পরিবর্তন হয়েছে? রুক্মিণী সহজ করে বললেন, ‘‘নারী নিজের জায়গা তৈরি করলে সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় তিনি যদি সেই পুরুষের সাফল্যকে অতিক্রম করেন, তখন।’’ কথা প্রসঙ্গে অমিতাভ বচ্চন ও জয়া ভাদুড়ি অভিনীত ‘অভিমান’ ছবিটির প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন অভিনেত্রী। সমাজ বদলালেও পুরুষের ‘অতি অহংকার’ এখনও রয়ে গিয়েছে বলেই মনে করেন তিনি। তবে পুরুষ মাত্রেই যে নারীকে কোণঠাসা করবেন, এই বক্তব্য সমর্থন করেন না রুক্মিণী। অভিনেত্রীর নিজের জীবনে কি কখনও এ রকম ঘটতে পারে? রুক্মিণীর উত্তর, ‘‘সময় সর্বশক্তিমান। কী হবে জানি না। এখনও সেটা হয়নি, এটুকু বলতেই পারি।’’
সাফল্য প্রসঙ্গে মনে এল, কবে প্রথম সাফল্যকে বুঝতে শিখেছিলেন বিনোদিনী? মনে পড়ল তাঁর ‘আত্মকথা’র অংশ।
‘শত্রুসংহার’ নাটকে (বিনোদিনী ভুল করে লিখেছেন ‘বেণীসংহার’) দ্রৌপদীর সখীর চরিত্রে জীবনে প্রথম মঞ্চে নামার অভিজ্ঞতা লিখেছেন: ‘...সমস্ত শরীর ঘর্ম্মাক্ত হইয়া উঠিল, বুকের ভিতর গুর্ গুর্ করিতে লাগিল, পা দুটীও থর্ থর্ করিয়া কাঁপিয়া উঠিল...’ দর্শকেরা অভিনয় দেখে হাততালি দিয়েছিলেন, কিন্তু এই মেয়ে তারও অর্থ জানে না। বড়রা বুঝিয়ে দিলেন, অভিনয় সফল হলে দর্শকরা আনন্দে করতালি দেন।
নারীই সমাজের চালিকাশক্তি
রুক্মিণী মনে করেন, পুরুষেরা শারীরিক দিক থেকে বলবান হলেও মনের দিক থেকে নারী অনেক বেশি শক্তিশালী। তাঁরা সহ্যশক্তির প্রতীক। অভিনেত্রীর কথায়, ‘‘মেয়েরা প্রতি মাসে ঋতুকালীন সময় যন্ত্রণা পেয়ে অভ্যস্থ। এ ছাড়াও একজন মহিলাকে সন্তান প্রসব করতে হয়। যন্ত্রণার অনুভূতিতে নারীরা পুরুষদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে।’’ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সমাজে মহিলারা অনেক বেশি স্বাধীন বলেই মনে করেন রুক্মিণী। তাঁরা প্রতিবাদীও। অভিনেত্রীর কথায়, ‘‘উপার্জনের সঙ্গেই আসে সাহস। তাই এখন অনেক মহিলাই হয়তো একা থাকতে চাইছেন। কেউ কেউ আবার সন্তানও চাইছেন না।’’
স্রষ্টার চরণে শিষ্যা
সময় ফুরিয়ে আসে। কিন্তু শিক্ষকের বাড়ি যাবেন না বিনোদিনী, হয়? সফরের শেষ গন্তব্য ছিল ‘গিরিশ ভবন’। এই প্রথম সেই বাড়িতে পা রাখলেন রুক্মিণী। সৌজন্যে আনন্দবাজার অনলাইন। তাই বাড়ির বাইরে গাড়ি থামতেই উচ্ছ্বাস ধরা পড়ল অভিনেত্রীর কণ্ঠে। পুরনো বাড়ির নোনা ধরা দেওয়াল, জমা জল সব পেরিয়ে পেরিয়ে গেলেন। রাস্তার দিকে মুখ করে থাকা জানলার সামনে এসে বললেন, ‘‘হয়তো এই জানলা থেকেই বিনোদিনী তাঁর আকাশ মেলে ধরতেন।’’
বাস্তব বনাম পর্দার গিরিশচন্দ্র
বাড়ির দেওয়ালের প্রস্তর ফলকে লেখা ‘বসত বাটী। মহাকবি গিরিশচন্দ্র ঘোষ’। সে দিকে তাকিয়ে রুক্মিণী বললেন, ‘‘আমি ছবির সেটের গিরিশ ঘোষের বাড়িতে গিয়েছি। কিন্তু আজ আসল বাড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। এটা সত্যিই আমার কাছে অন্য রকম প্রাপ্তি।’’ ছবিতে গিরিশ ঘোষের চরিত্রে অভিনয় করেছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। অভিনেত্রী জানালেন, বাস্তবের মতোই শুটিংয়ের সময়ও কৌশিক তাঁকে গড়েপিটে নিয়ে ছিলেন। রুক্মিণী বুঝিয়ে দিলেন, ‘‘সংলাপ বলা থেকে শুরু করে সেই সময়ের ইতিহাস নিয়ে কৌশিকদার থেকে অনেক কিছু শিখেছি।’’ গুরুকে শ্রদ্ধা করেন, তা বলে আত্মমর্যাদার প্রশ্নে আপস নয়। বিনোদিনী তাঁর শিক্ষককে নিজের বইয়ের ভূমিকা লিখতে অনুরোধ করেছিলেন, গিরিশচন্দ্র লিখেও দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘আমার কথা’র প্রথম সংস্করণে সেই ভূমিকা ছাপেননি বিনোদিনী। অভিনয়ের বাইরে যে নারী দেহপোজীবিনীর জীবন কাটায়, তাঁর জীবনী বা আত্মকথা লেখার কারণ ও পশ্চাৎপট ভূমিকায় ব্যাখ্যা করেছিলেন গিরিশ।
তথ্যচিত্র তৈরি করতে চাইনি!
এই ছবি কি বিনোদিনীর সমকালের প্রেক্ষাপটে তৈরি? তা নিয়ে সমাজমাধ্যমে চর্চা লক্ষ করা গিয়েছে। প্রসঙ্গ তুলতেই রুক্মিণী সমকালের পক্ষেই ভোট দিলেন। সঙ্গে তাঁর আক্ষেপের কথাও জানালেন , ‘‘‘দেবদাস’ নিয়ে হিন্দি ছবি তৈরি হলে তখন বাঙালি প্রশ্ন তোলে না! পারো এবং চন্দ্রমুখী ‘ডোলা রে’ গানে নাচলে তখন তো সময়কাল নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না! আমি বিনোদিনীকে ভারতের নিরিখে নির্মাণ করতে চেয়েছি, যে কারণে হিন্দি গান এসেছে। বাঙালি নন, এমন মানুষও যেন ওঁর কথা জানেন। তথ্যচিত্র তৈরি করতে চাইনি।’’
নটী নন, নারী হয়ে ওঠার গল্পই বিনোদিনীর গল্প। সেই গল্পে প্রবেশ করলেন আরও এক অভিনেত্রী, যাঁর নাম রুক্মিণী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy