Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

কথার কথা

একশত দুই লক্ষ কোটি টাকা— অঙ্কটি শুনিতে বিলক্ষণ গালভরা। কিন্তু, মুখের কথায় অর্থব্যবস্থার চাকা নড়ে না।

নির্মলা সীতারামন। —ফাইল চিত্র

নির্মলা সীতারামন। —ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

হাওয়ার নাড়ুও বলা যাইতে পারে, কুমিরছানা বলিলেও আপত্তি নাই। কিন্তু, ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার পাইপলাইনকে যুগান্তকারী, অথবা আর্থিক মন্দা হইতে নিস্তার পাইবার পথ বলিলে মুশকিল। একশত দুই লক্ষ কোটি টাকা— অঙ্কটি শুনিতে বিলক্ষণ গালভরা। কিন্তু, মুখের কথায় অর্থব্যবস্থার চাকা নড়ে না। হিসাবটি ভাঙিলে দেখা যাইতেছে, পরিকাঠামো খাতে কেন্দ্রীয় সরকার বৎসরে আট লক্ষ কোটি টাকা খরচ করিবে। বর্তমান অর্থবর্ষের বাজেটেই পরিকাঠামো খাতে বরাদ্দ হইয়াছে ৭.৮৮ লক্ষ কোটি টাকা। ইহা যদি পাইপলাইন হয়, তবে বাজেট কোথায়? বাজেট বরাদ্দের উপর দেড় শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি করিবে সরকার, এই কথাটুকু বলিতে সাড়ে চার মাস সময়, আমলাশোভিত টাস্কফোর্স ইত্যাদির প্রয়োজন হয় কি? সিদ্ধান্ত হইয়াছে, পাঁচ বৎসর ধরিয়া পরিকাঠামো খাতে যে লগ্নি হইবে, তাহার ৩৯% করিবে কেন্দ্রীয় সরকার— স্পষ্টতই, পরিকাঠামো খাতে বাজেটে স্বাভাবিক ভাবেই যে বরাদ্দ থাকে, কেন্দ্রের ভাগে কম-বেশি সেই খরচই পড়িতেছে— আরও ৩৯% খরচ করিবে রাজ্য সরকারগুলি। নির্মলা সীতারামন যে ১০২ লক্ষ কোটি টাকার হিসাব শুনাইয়াছেন, তাহার মধ্যে রাজ্য সরকারের এই খরচও ধরা আছে। দেশের সব রাজ্য কি পরিকাঠামো খাতে এই খরচ করিতে সক্ষম? আর্থিক ক্ষমতা যদি থাকেও, এই খরচ কি প্রতিটি রাজ্যের নিকটই অগ্রাধিকার পাইবে? যদি রাজ্যগুলি এই খরচে অসম্মত হয়, তবে মোট ব্যয়ের ছবিটি কী দাঁড়াইবে?

অর্থমন্ত্রী স্বভাবতই প্রশ্নগুলির অস্তিত্ব স্বীকার করেন নাই। আশঙ্কা হয়, পরিকাঠামো খাতে প্রকৃত লগ্নির তুলনায় তাঁহাদের নিকট অনেক বেশি জরুরি ছিল বৎসরান্তের ‘ধামাকা’— চোখ ধাঁধাইয়া দেওয়ার মতো অঙ্কের ঘোষণা। সেই ঘোষণায় যে অর্থনীতির চিঁড়া ভিজিবে না, তাঁহারা সম্ভবত জানেন। বৃহত্তর আশঙ্কাটি এইখানেই— নরেন্দ্র মোদীরা কি আদৌ অর্থনীতি লইয়া ভাবিত? না কি, নাগরিকত্ব আইন লইয়া যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলিতেছে, তাহা হইতে মানুষের মন ঘুরাইয়া দেওয়াই তাঁহাদের মূল উদ্দেশ্য? ১০২ লক্ষ কোটি টাকার যে কাহিনি তাঁহারা শুনাইতেছেন, সামান্য পাটিগণিতের ধাক্কাতেই যে তাহা ধসিয়া পড়িবে, ইহা তাঁহাদের না জানিবার কোনও প্রশ্নই নাই। প্রকৃত অর্থনীতি যে এই গালভরা গল্পের তোয়াক্কা করিবে না, এবং তাহাতে বৃদ্ধির চাকা নড়িবে না, তাহাও জানা কথা। অতএব, পড়িয়া থাকে একটিই সম্ভাবনা— তাঁহারা, আরও এক বার, ভারতের সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝাইতে চেষ্টা করিতেছেন। সম্ভাবনাটি ভয়ঙ্কর, কিন্তু যাবতীয় পারিপার্শ্বিক প্রমাণ বলিতেছে, এই ভয়ঙ্কর কথাটিই সত্য।

কেহ আপত্তি করিয়া বলিতে পারেন, বেসরকারি ক্ষেত্র তো আছে। প্রয়োজনে তাহাই পরিকাঠামো ক্ষেত্রের প্রধান চালিকাশক্তি হইয়া উঠিবে। কথাটি শুনিতে ভাল, এবং নীতিগত ভাবে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু, বেসরকারি ক্ষেত্র লগ্নি করিবার পূর্বে স্বভাবতই লাভের হিসাব কষিবে। লাভের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকিলে তবেই সেই লগ্নি আসিবে। অর্থব্যবস্থা যখন দ্রুত গতিতে চলিতে থাকে, তখন পরিকাঠামো ক্ষেত্রে লগ্নি লাভজনক। ভারতীয় অর্থনীতি বর্তমানে খাদের কিনারায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, এবং পূর্বাভাস বলিতেছে যে অদূর ভবিষ্যতে নিস্তারের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই অবস্থায় ভারতে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে লগ্নি বেসরকারি ক্ষেত্রের নিকট আকর্ষণীয় ঠেকিবে কেন? বিশেষ কোনও শিল্পগোষ্ঠী তাহাদের বিশেষ কোনও প্রকল্পে বিশেষ সুবিধা পাইতে পারে— সেই সম্ভাবনা আছে। কিন্তু, তাহা সাঙাৎতন্ত্রের গল্প, তাহাকে বেসরকারি লগ্নির ভিত্তিতে পরিকাঠামোর উন্নয়ন বলিয়া চালাইবার চেষ্টা করিলে, সরকারি কৃতিত্ব বলিলে, মানুষের সহিত আরও এক দফা তঞ্চকতা হইবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy