Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

দেশি খেলারা সব গেল কোথায়

বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হয়তো জানেই না ‘ইচিং-বিচিং’, ‘সীতাহরণ’, ‘পিট্টু’, ‘গাদি’, ‘সারি-সুয়া’, ‘কুমির-ডাঙা’, ‘কাচ লুকোলুকি’, ‘পাতা লুকোলুকি’-র মতো খেলার নাম। যেগুলির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাদের পূর্বসূরিদের শৈশব। লিখছেন রাজীব তন্তুবায়

এমন ছবিই হারাতে বসেছে। ছবি: শুভেন্দু তন্তুবায়

এমন ছবিই হারাতে বসেছে। ছবি: শুভেন্দু তন্তুবায়

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৯ ০০:৩২
Share: Save:

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতা গ্রাস করছে আমাদের। বদলে যাচ্ছে চিত্রপট, শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে। গ্রাম বলতে এক সময়ে ছিল অবাধ স্বাধীনতা, উন্মুক্ত প্রান্তর আর ছেলেমেয়েদের নিরলস খেলাধুলো ও দুরন্তপনা। আজ সেখানে উল্টো ছবিটাই চোখে পড়ে বেশি। কালক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে কত কিছু। যে ভাবে হারাচ্ছে গ্রামবাংলার নানা খেলাধুলোও। এই সব খেলাধুলোর প্রাণ‌ই ছিল ধুলোবালি আর মাটির প্রতি মমত্ববোধ। সামাজিক বিবর্তনের স্রোতে তারা আজ বিরল প্রাণীদের মতোই লুপ্তপ্রায়।

বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হয়তো জানেই না ‘ইচিং-বিচিং’, ‘সীতাহরণ’, ‘পিট্টু’, ‘গাদি’, ‘সারি-সুয়া’, ‘কুমির-ডাঙা’, ‘কাচ লুকোলুকি’, ‘পাতা লুকোলুকি’-র মতো খেলাগুলোর নাম। যেগুলির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাদের পূর্বসূরিদের শৈশব তথা ছেলেবেলা। শহরের ছেলেমেয়েদের কথা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। তাদের পরিবেশ গ্রাম্যজীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার গ্রামগুলিও কি ভুলে যাচ্ছে না তার অতি প্রিয় খেলাগুলিকে?

এক দশক আগেও একটু খেয়াল করলে চোখে পড়ত গাছের তলায়, ফাঁকা মাঠে কিংবা রাস্তার ধারে, সকাল হোক বা পড়ন্ত বিকেল, পায়ের উপরে পা, হাতের উপরে হাত দিয়ে ‘ইচিং-বিচিং’ খেলছে ছেলেমেয়ের দল। কখনও বা মাটিতে গোল গোল ঘর এঁকে ‘মাংসচুরি’। ‘সীতাহরণ’ খেলাতে তারা এমন ব্যস্ত যে ঝড় বয়ে গেলেও হয়তো টের পাবে না।

এই সব খেলার উপকরণগুলি ছিল অত্যন্ত সাধারণ তথা সহজলভ্য। ইট, পাথর, গাছের ডাল, পাতা, কাচের ভাঙা চুড়ি, ভাঙা টালি প্রভৃতি। ছেঁড়া প্লাস্টিক ও কাপড়ের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে বল তৈরি করে, ভাঙা টালি গোল গোল করে ঘুঁটি বানিয়ে থাকে থাকে সাজিয়ে ‘পিট্টু’ খেলার মজাই ছিল আলাদা। শীতকালে যখন খামারে ধান উঠত, সার সার খড়ের পালুই তৈরি হত, সেখানে অনায়াসে চলত লুকোচুরি খেলা। উল্লেখ করার মতো বিষয় এই যে, এই সব খেলাগুলি ছেলেমেয়েরা এক সঙ্গে অনেকটা বড় হওয়া পর্যন্ত এক সঙ্গেই খেলত। কিন্তু এখন এই বোধটা যেন খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে— ‘আমরা ছেলে, ওরা মেয়ে’। ফলে, একটু বড় হ‌ওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলেমিশে খেলার প্রবণতাটা যেন অনেকাংশে কমে আসছে।

এই প্রসঙ্গে বলি, ছেলেদের জন্যও নির্দিষ্ট কিছু খেলা ছিল। যেমন— ‘ডাং গাদাগাদি’, ‘গুলিডাণ্ডা’ (স্থানভেদে যার নাম ‘তীর-ডাং’) প্রভৃতি। গরমে যখন পুকুর, ডোবা বা অন্য জলাশয় শুকিয়ে যেত এবং তার পাড়ে নরম মাটি বা পাঁক বেরিয়ে আসত, সেখানে ‘ডাং’ অর্থাৎ, পোক্ত লাঠি সজোরে পুঁতে দেওয়া হত। আর অন্য জন সেই লাঠিকে নিজের লাঠি দিয়ে ভূলুণ্ঠিত করে দখলে নিত। যে ছেলে সকলের লাঠি শেষমেষ নিজের দখলে নিতে পারত সে-ই হত ‘রাজা’। এই ‘ডাং গাদাগাদি’ খেলার মধ্যে যেন একটা আলাদা পৌরুষ ফুটে উঠত। যদিও ‘কিত্ কিত্’ বা ঘুঁটি খেলা ইত্যাদি ছিল মেয়েদের নিজস্ব খেলা। তা হলেও কখনও কখনও ছেলেরাও সেখানে স্বচ্ছন্দে যোগ দিতে পারত।

শুধু বাইরের খেলা নয়, কিছু ‘ইন্ডোর গেমস্’-ও ছিল গ্রামবাংলার একেবারে নিজস্ব। যেমন ‘বাঘ-ছাগল’, ‘ছাতপাত’, ‘অষ্টচৌকা’, ‘কড়ি’ ইত্যাদি। এই সব খেলাগুলি মেঝেতে খড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট ঘর কেটে ইটের টুকরো, ছোট ছোট পাথর বা কাঠের ঘুঁটি তৈরি করে খেলা হত। ‘অষ্টচৌকা’ খেলার জন্য কড়ি বা ভাঙা তেঁতুলবীজ লাগত দান ফেলার সময়ে।

এই খেলাগুলি খেলতে যথেষ্ট বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হত। গ্রীষ্মের জ্বলন্ত দুপুর বা অস্বস্তিকর সন্ধ্যায় অবসর বিনোদনের পক্ষে মা-ঠাকুমাদের কাছে এই খেলাগুলোর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। শুধু মা-ঠাকুমারাই নয়, আট থেকে আশি প্রায় সকল ছেলেমেয়ে‌ই এই খেলায় যোগ দিতে পারত। এতে অবসর যাপনের সঙ্গে খেলত মাথাও। এ সবের প্রতি আগ্রহ এখন আর কোথায়? সব কিছুই যেন শুষে নিয়েছে টিভি আর স্মার্টফোন।

আজ গ্রামবাংলার খেলার মাঠে তাই অনায়াসে বেড়ে উঠছে চোরকাঁটা। যে বয়সে মাঠে গিয়ে শরীর গঠনের কথা, সেই বয়সে গৃহবন্দি থেকে সারাক্ষণ মোবাইলে ঝুঁকে থাকছে মাথা। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, কিন্তু তা প্রায় হাতেগোনা। শুধু গ্রাম্য খেলাধুলো‌ থেকেই নয়, সামগ্রিক ভাবেই খেলাধুলো থেকে যেন কিছুটা মুখ ফিরিয়েছে বর্তমান যুবসমাজের একটি বড় অংশ। ক্রিকেট বলতেও তাদের অনেকে কেবল টি-২০ বোঝে।

আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় জীবনযাপন রীতি। কিন্তু সংস্কৃতি? তাকে কি বদলে দেওয়া যায়? আমাদের গ্রামবাংলার একেবারে নিজস্ব সংস্কৃতির অঙ্গ এই সমস্ত খেলাগুলি, যেগুলি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্ম, সেগুলিকে ধরে রাখার দায় কাদের? বর্তমান প্রজন্মের বাবা-মা তথা অভিভাবক-অভিভাবিকারা কি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী নয়? সমাজের যাঁরা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি, তাদের কি কিছুই করণীয় নেই? এখন থেকে একটু যত্ন না নিলে, অদূর ভবিষ্যতে এই সব খেলাগুলি হয়তো শুধু মা-দিদিমাদের কাছে শোনা গল্প হয়েই রয়ে যাবে।

লেখক ইঁদপুরের সাহিত্যকর্মী ও শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

Children Childhood Games
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy