অনুশীলন: মেদিনীপুর কলেজের মাঠে মেয়েরা তৈরি হচ্ছেন। নিজস্ব চিত্র
পার্থক্য ১৭ বছরের। বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ছাত্র এবং ছাত্রীদের ফুটবল প্রতিযোগিতার শুরুর পার্থক্য। প্রায় দু’দশক ধরে জেলার মেয়েরা বিদ্যালয় স্তরের পরে আর ফুটবল খেলার সুযোগ পাননি। কারণ কলেজ স্তরে মেয়েদের ফুটবল খেলার কোনও সুযোগ ছিল না। কিন্তু গত ১৭ বছর ধরে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে আন্তঃকলেজ ছেলেদের ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়ে আসছে। চলতি বছরে শুরু হতে চলেছে মেয়েদের আন্তঃকলেজ ফুটবল প্রতিযোগিতা। আগামী ২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিযোগিতা শুরু হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষুদিরাম ক্রীড়াঙ্গনে।
উদ্যোগ শুরু হয়েছিল গত বছরে। উপাচার্য রঞ্জন চক্রবর্তী কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বিভিন্ন কলেজে খোঁজ নিয়ে দেখেছিলেন বেশ কিছু কলেজেই ভাল ফুটবল খেলেন এমন মেয়েরা রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের জঙ্গলমহল কাপ বা বিদ্যালয় স্তরের পরে আর খেলার সুযোগ হয়নি।
ফুটবলারের খোঁজ মেলার পরে দল তৈরির চেষ্টা শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের দল তৈরির জন্য ট্রায়াল নেওয়া হয়। ২০১৮ সালে মেয়েদের দল উত্তরপ্রদেশের কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যায়। প্রথমবার যোগ দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত দৌড়ের সাফল্যে খুশি কর্তৃপক্ষ। ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় আন্তঃকলেজ মহিলা ফুটবল শুরু করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া আধিকারিক সুহাস বারিক জানান, ১৩টি কলেজ এই প্রতিযোগিতায় যোগ দিচ্ছে। কলেজগুলি হল, মেদিনীপুর কলেজ, গড়বেতা কলেজ, ডেবরা কলেজ, রাজা এন এল খান উইমেন কলেজ, শিলদা কলেজ, খেজুরি কলেজ, সেবাভারতী মহাবিদ্যালয়, হলদিয়া গভর্মেন্ট কলেজ, বাজকুল মিলনী মহাবিদ্যালয়, সুবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয়, নয়াগ্রাম পি আর এম গভর্নমেন্ট কলেজ, এস বি এস এস গোয়ালতোড় কলেজ, নাড়াজোল রাজ কলেজ। এদের সঙ্গে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর মহিলা দল খেলবে। সব মিলিয়ে ১৪টি দল।
কিন্তু উদ্যোগ ধাক্কা খাচ্ছে অন্য জায়গায়। পুরোপুরি ফুটবলার এমন ১১ জনকে মিলছে না। মেদিনীপুর কলেজের প্রশিক্ষক প্রদীপ ঘোষ দেখেন মাত্র তিনজন ছাত্রী নিয়মিত ফুটবল খেলে। পুষ্পিতা চক্রবর্তী, রূম্পা রাউল এবং সুপ্রিয়া সিংহ অ্যাথলেটিক্স ও খো-খো খেলায় পারদর্শী। রূম্পার কথায়, ‘‘আগে কোনওদিন ফুটবল খেলিনি। নতুন খেলা শিখতে খুব আনন্দ হচ্ছে।’’ পুষ্পিতা বলেন, ‘‘আমি রানার। কবাডি ও খো-খো খেলি। তাই বল নিয়ে দৌড়তে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়ব না। শুধু বল ধরা-ছাড়া, বল দখল সহ কিছু বিষয় জানতে হবে।’’ তবে পাঁচখুরির তুর্কি সরেন ছোট থেকেই ফুটবল খেলেছে। বিদ্যালয়ে পড়ার সময় জঙ্গলমহল কাপ ও সৈকত কাপে খেলেছে। কেরানিচটি ফুটবল কোচিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার ফুটবল খেলার অভ্যাস আছে। তাই ভয় নেই।’’ কলেজের প্রশিক্ষক মুনমুন মাইতি বলেন, ‘‘প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। আশা করি, ওরা কয়েক দিনের মধ্যে ফুটবল ভালই শিখতে পারবে।’’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল প্রশিক্ষক অমিত কিস্কু স্নাতকোত্তর বিভাগের দল তৈরি করতে গিয়ে বেশ বিপাকে। বেশির ভাগ মেয়েই প্রথমবার ফুটবলে পা দিচ্ছে। গোপীবল্লভপুরের মেয়ে করুণা টুডু ও কণীনিকা হেমব্রম কোনওদিন মাঠে যাননি। বন্ধুরা অনুরোধ করায় তাঁরা মাঠে নেমেছেন। বাঁকুড়ার মেয়ে ববিতা টুডু প্রথমবার ফুটবলে পা দিলেন। তাই ৪-৫ দিনের মধ্যে কী ভাবে দল তৈরি হবে ভেবেই চিন্তিত প্রশিক্ষক। তবে দলের বাকিদের ভরসা দিচ্ছেন বিনপুরের দুই মেয়ে সাবনী মণ্ডল ও দীপালি মুর্মু। এঁরা দু’জন নিয়মিত ফুটবলার না হলেও বিনপুর হাইস্কুলের দলে ও জঙ্গলমহল কাপে একাধিকবার খেলেছে। অমিত জানান, খুব ভাল দল না হলেও কাজ চালানোর মতো দল হয়ে যাবে।
তবে কিছু কলেজ একটু সুবিধেজনক পরিস্থিতিতে। যেমন ঝাড়গ্রামের নয়াগ্রাম পি আর এম গভর্নমেন্ট কলেজ। শারীরশিক্ষা বিভাগের প্রধান স্বদেশ পান বলেন, ‘‘দল ভালই হবে। কারণ এই কলেজে কয়েকজন ছাত্রী বিদ্যালয় স্তরে জাতীয় প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে। দু’জন ছাত্রী রাজ্য ও জাতীয় স্তরে রেফারি। তবে কিছু নতুন মেয়েকে তৈরি করতে হবে।’’ স্বদেশবাবু জানিয়েছেন অন্য অসুবিধের কথা। তিনি সকলকে একসঙ্গে পাচ্ছেন না। তবে তিনি আশাবাদী, ‘‘জঙ্গলমহলের মেয়েরা ফুটবল খেলায় পারদর্শী। তাই নতুন মেয়েরাও ভালই ফুটবল খেলবে।’’
পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরি কলেজের দল তৈরিতেও খুব একটা সমস্যা নেই। গত বছর এই কলেজের দু’টি মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দলে সুযোগ পেয়ে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় খেলেছে। তাছাড়া, কলেজের অনেক মেয়েই ভাল ফুটবল খেলে। খেজুরিতে ‘প্রয়াস’ ফুটবল কোচিং সেন্টারে মেয়েরা নিয়মিত অনুশীলন করেন। হলদিয়া গভর্মেন্ট কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক সুশান্ত পাল ছাত্রীদের উপর ভরসা করেন। সুশান্তবাবু জানান, এই কলেজে অনেক মেয়েই নিয়মিত ফুটবল খেলেন। বিদ্যালয় স্তরে তাঁরা জাতীয়স্তরের প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছেন। গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের দলে ৪-৫ জন মেয়ে খেলেছেন। তাই ভাল দলই হবে তাঁদের।
জঙ্গলমহলের কলেজগুলোতে দল মোটামুটি তৈরি হয়ে যাবে বলেই আশা। কিন্তু সার্বিক চিত্র তো খুব একটা স্পষ্ট নয়। কেন? কারণ অনেক জায়গায় মেয়েরা ফুটবল শিখতে চাইলেও বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষকদের তেমন উৎসাহ থাকে না। গ্রামের মাঠেও মেয়েরা খেলার জায়গা পায় না। এলাকায় কোনও ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকলে তবেই মেয়েরা ফুটবল শিখতে পারে।
এই সমস্যা সমাধানে কী করা উচিত? ছোট থেকে ফুটবল চর্চার সুযোগ তৈরি করা। সেজন্য অবশ্য এআইএফএফ ৭-১৩ বছরের বাচ্চাদের নিয়ে বেবি ফুটবল লিগ শুরু করেছে। ২০১৮ সাল থেকে পূর্ব মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলায় শুরু হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল ও পটাশপুরের টিকরাপাড়ায় খেলা হয়েছে। তার সঙ্গে ছোট থেকে মেয়েদের মাঠে আনার কাজটিও সেই সঙ্গে করতে হবে। না হলে লিগের আয়ু বেশিদিন হবে না। অভিজ্ঞদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতা শুরু হলে মেয়েদের ফুটবল খেলায় আগ্রহ বাড়বে। বিদ্যালয় স্তরের ফুটবল খেলা মেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাটাও চালিয়ে যেতে পারবেন।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রঞ্জন চক্রবর্তীর মতও তাই। তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন জায়গায় ছেলে মেয়ে সবাই ফুটবল খেলে। তাহলে কলেজের মেয়েরা কেন পিছিয়ে থাকবে। এই খেলার মাধ্যমে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। এতে মেয়েদের সামাজিক উন্নতি ঘটবে। সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতিতে সাহায্য করবে।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া আধিকারিক সুহাস বারিক জানান, আন্তঃ কলেজ প্রতিযোগিতা থেকে ৪০ জন খেলোয়াড়ের তালিকা তৈরি করা হবে। তাঁদের থেকে চূড়ান্ত বাছাই করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দল তৈরি হবে। পরে এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় পাঠানো হবে।’’
সুযোগ বাড়তে চলেছে। এবার সাফল্যের অপেক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy