সুভাষচন্দ্র বসু। ফাইল ছবি।
পুর পরিষেবার টাকার যোগান দিতে নিজের বেতন অর্ধেক করে দিয়েছিলেন কলকাতা পুরসভার এক কর্তা। নাম সুভাষচন্দ্র বসু। পরে সারা বিশ্ব যাঁকে জানবে ‘নেতাজি’ বলে। ভোটে জিতে কাউন্সিলর হওয়ার পর পুরসভার সিইও করা হয়েছিল সুভাষকে। পুরসভার আর্থিক অবস্থা তখন স্বাস্থ্যকর নয়। অথচ অত্যাবশ্যক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরিষেবা দিতে হবে মানুষকে। খরচে রাশ টানার জন্য নিজের বেতন অর্ধেক করে দিয়েছিলেন সংস্থার সিইও সুভাষ!
১৯২৪ সালে ব্রিটিশ ভারতে প্রথমবার ভোটে জিতে কলকাতার মেয়র হন চিত্তরঞ্জন দাশ। বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯২৩ অনুযায়ী সেটাই কলকাতা পুরসভার প্রথম নির্বাচন। কাউন্সিলর নির্বাচিত হন দেশবন্ধুর ভাবশিষ্য সুভাষ। গুরুই তাঁর শিষ্যকে সিইও-র দায়িত্ব দেন। দেশবন্ধুর এতটাই আস্থা ছিল নেতাজির উপর। দেশবন্ধুর আস্থার পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছিলেন সুভাষ।
দু'জনে মিলে কলকাতার নাগরিকদের উন্নত মানের পরিষেবা দিতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য যে বিপুল অর্থ প্রয়োজন, তা মঞ্জুর করেনি ব্রিটিশ সরকার। পরিকল্পনা রূপায়ণের মূল দায়িত্ব ছিল সিইও-র ঘাড়ে। খরচ কমাতে তিনি যে দাওয়াই দিয়েছিলেন, তাতে সকে বিস্মিত! তখন সিইও-র বেতন ছিল মাসিক তিন হাজার টাকা। সুভাষ জানিয়ে দেন, তিনি অর্ধেক বেতন নেবেন। বাকি টাকাটা ব্যয় করা হবে পরিষেবা খাতে। এর পরে আর কোনও কড়া সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হয়নি সিইও-কে। সঙ্কটের সময়ে নিজে পথে নেমে পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করার নজির সৃষ্টি করে গিয়েছেন সুভাষ।
ঘোর বর্ষার মধ্যে একদিন গামবুট পরে অফিসে চলে এসেছিলেন সুভাষ। বৃষ্টি শুরু হতেই চলে গেলেন ঠনঠনিয়া (এখনকার মতো তখনও অল্প বৃষ্টি হলেই ঠনঠনিয়া ভাসত)। সিইও-কে দেখে ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার, কর্মীরাও সাততাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলেন সেখানে। জল নামাতে যুদ্ধকালীন তৎপরতা শুরু হল। মানুষের আস্থা কী করে আদায় করতে হয় এবং পুরসভার কর্মীদের কী ভাবে সর্বাত্মক ভাবে কাজে নামাতে হয়, সেই কৌশল জানা ছিল সুভাষের। তবে ‘কৌশলী’ সুভাষ পুর প্রশাসক হিসেবে অত্যন্ত কড়াধাতেরও ছিলেন।
নির্বাচিত পুরবোর্ড গঠনের আগেও ব্রিটিশরা সব সময় শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। শহরের আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য একাধিক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন । যেমন, দিনে দু’বার রাস্তায় পড়ত ঝাঁট। কোথাও কোথাও জল দিয়ে রাস্তা ধোওয়া হতো। ঘোড়ায় টানা গাড়িতে জঞ্জাল উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলা হত নির্দিষ্ট জায়গায়। এমনকি, মানুষ যাতে যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ না করে, সে জন্য মোড়ে মোড়ে ছিল শৌচাগার। আর ছিল জঞ্জাল ফেলার ট্রেন। কিন্তু সেই ট্রেন ব্রিটিশ বাসিন্দাদের এলাকার পাশ দিয়ে যেত না। যেত উত্তর কলকাতার বিভিন্ন এলাকার মধ্যে দিয়ে। সেখানকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগে পড়তে হত।
জঞ্জাল ফেলার ট্রেন শহরের আবর্জনা নিয়ে চলে যেত ধাপার মাঠে। বাগবাজারের অন্নপূর্ণা ঘাটের সামনে থেকে শুরু করে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে (এখন বিধান সরণি) এসে সার্কুলার রোড ধরে ধাপা পর্যন্ত চলে যেত। রাজাবাজার ও উল্টোডাঙা মোড়ে দুটি প্ল্যাটফর্ম ছিল। ওই দুই প্ল্যাটফর্মে রেলের কামরায় আবর্জনা ভর্তি করা হত। আর ওই প্ল্যাটফর্মগুলিতে এসে হাজির হত ঘোড়ায় টানা আবর্জনাভর্তি গাড়িগুলি (রাজাবাজারে সেই থেকেই ঘোড়ার গাড়ির গ্যারেজ)। সেগুলি যখন প্ল্যাটফর্মের ধারে দাঁড়িয়ে থাকত, দুর্গন্ধে এলাকার মানুষের দমবন্ধ হওয়ার যোগাড়। ঝোড়ো হাওয়ায় জঞ্জাল অনেক সময় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ত। জঞ্জাল ছিটকে পড়ত, যখন মালগাড়িগুলি জঞ্জাল নিয়ে যেতে যেতে ব্রেক কষলে।
প্রশাসক হিসেবে সুভাষই এসে আবর্জনার রেলগাড়ি পরিষেবা বন্ধ করে দেন। ঘোড়ায় টানা গাড়িগুলি সরাসরি আবর্জনা নিয়ে গিয়ে ফেলতে শুরু করে ধাপায়। পুরসভা যে সব পরিষেবা দেয় বা উন্নয়নের কাজ করত, তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ১৯২৪ সালের ১৫ নভেম্বর প্রকাশিত হয় পুর সংবাদপত্র ‘ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট’। যার মূল কান্ডারিও ছিলেন সুভাষ।
ওই গেজেটের প্রথম সংখ্যা থেকে জানা যায়, মেয়র হিসেবে চিত্তরঞ্জন দাশের প্রথম বক্তৃতায় অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, দরিদ্রদের জন্য চিকিত্সা, সস্তায় খাঁটি খাবার ও দুধ সরবরাহ, বস্তি এলাকায় উন্নততর পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা, দরিদ্রদের জন্য গৃহনির্মাণ প্রকল্প, সংযোজিত পুর এলাকার উন্নয়ন, যানবাহন ব্যবস্থার উন্নতি এবং খরচ কমিয়ে প্রশাসনের উন্নয়নের উল্লেখ ছিল।
ব্রিটিশ সরকার অবশ্য সুভাষকে বেশিদিন পুর প্রশাসক থাকতে দেয়নি। ১৯২৪ সালের অক্টোবরে বিপ্লবীদের যোগাযোগের অভিযোগে ব্রিটিশ সরকার সুভাষকে গ্রেপ্তার করে। ১৯২৭ সালে তিনি মুক্তি পান। পরবর্তীকালে কলকাতা পুরসভার মেয়র হন। নির্বাচিত হন অল্ডারম্যানও। কিন্তু পুরসভা পরিচালনার পূর্ণ সময় তিনি পাননি। ১৯৩১ সালের ২৬ জানুয়ারি মেয়র সুভাষের নেতৃত্বে একটি মিছিলের উপর লাঠি চালায় পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় মেয়র সুভাষচন্দ্র বসুকে। পুরসভা পরিচালনার সঙ্গে তাঁর প্রশাসনিক যোগাযোগের সেখানেই ইতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy