সুভাষ ঘরে ফেরে নাই বলে বাঙালি অশ্রুবর্ষণ করে। সুভাষের লেখা বাঙালি পড়ে কি? পড়লে কিন্তু বাঙালি সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে লড়তে পারত।
১৯৩৪ সালে অসুস্থ সুভাষচন্দ্র ইউরোপে। লিখছেন তাঁর ইংরেজি বই দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল। তাঁকে বই লেখার কাজে সাহায্য করছিলেন ভবিষ্য-সহধর্মিনী এমিলি শেঙ্কল। এ বই তো কেবল তথ্য দিয়ে সাজানো নয়, ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাসের ভাষ্য রচনা করছেন নেতাজি। তাঁর বই শুরু করেছিলেন ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার পটভূমির বিবরণে। যখন ইংরেজরা এদেশে আসেনি সেই
পুরনো ভারতের ইতিহাস রচনায় কৌশলী সাহেবদের ও তাঁদের অনুরাগী ভারতীয়দের মনোযোগ কম। লিখলেও তাঁরা পুরনো ভারতে স্থানীয় শাসকদের পারস্পরিক লড়াইকে বড় করে দেখান। জানাতে চান ইংরেজরা আসার আগে এ দেশে কোনও সুগঠিত শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। আবার কেউ কেউ কল্পনা করেন হিন্দু ভারতের, যেন মুসলমান শাসন এদেশে নিতান্ত বহিরাগত উপসর্গ মাত্র, তা ভারতীয় নয়। এই ইতিহাস-ভাবনার বিরোধিতা করেছিলেন নেতাজি।
তখন খনন-কার্যের ফলে হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর নগর সভ্যতার কথা জানা গেছে। লিখেছিলেন, ‘‘আর্যদের ভারত-বিজয়ের আগে’’ ‘‘ভারতবর্ষ সভ্যতার এক উন্নত স্তরে উপনীত হয়েছিল।’’ সুভাষের আর্যামির মোহ ছিল না। জাতিগর্বী জার্মানদের মতো নন তিনি। আর্যহিন্দুর অহমিকায় অন্য ভারতীয়দের দেশ ছাড়া করার কথা তিনি ভাবেনই না। এ দেশের মুসলমান শাসকদের অবদানের কথা জানান তিনি। লেখেন, ‘‘হিন্দু ধর্ম গ্রহণ না করলেও’’ মুসলমানদের আসার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে নতুন সাংস্কৃতিক সমন্বয় গড়ে ওঠে। ‘‘ভারতবর্ষকে তাঁরা স্বদেশ বলে মেনে নিয়েছিলেন এবং জনগণের সাধারণ সামাজিক জীবনে তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন। পারস্পরিক সহযোগিতায় এক নতুন শিল্প-সংস্কৃতির উদ্ভব হল, প্রাচীন কালের থেকে পৃথক হলেও তা ছিল স্পষ্টতই ভারতীয়।’’ সুভাষের এই সিদ্ধান্ত ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার, কালিকারঞ্জন কানুনগোর লেখায় সমর্থিত হয়েছিল। ভাষাচার্য ও সংস্কৃতিবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভারতীয় মুসলমানদের এই অবদান সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। শুধু সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের কথাই বলেননি সুভাষ, মুসলিম শাসকদের প্রশাসনিক পদ্ধতির কথাও লিখেছিলেন তাঁর ভারতের মুক্তি সংগ্রাম বইটিতে। তাঁরা জনগণের দৈনন্দিন জীবনকে স্পর্শ করেননি, হাত দেননি গ্রাম্য সাধারণের পুরনো ব্যবস্থাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থায়।
ভারত-ইতিহাসের ধারাকে এ ভাবে পড়েছিলেন বলেই প্রশাসক সুভাষচন্দ্র সেই ইতিহাসের সমন্বয়ী ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের কাছে যথার্থ অর্থে ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। দেশবন্ধু তাঁর দেশের কথা বইতে ভারতবর্ষের স্থানীয় শাসনব্যবস্থার পুনর্নবীকরণের যে পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছিলেন তা পাশ্চাত্যের হোমরুল মুভমেন্টের অনুসারী মাত্র ছিল না। চিত্তরঞ্জন মনে করতেন দেশজ ব্যবস্থাপনা বিচার করে আমাদের দেশের প্রশাসনিকতাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে সুভাষ বোঝেন, প্রশাসন চালাতে গেলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সমস্যা, প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুধাবন করা চাই। ভারতীয় সভ্যতার অচ্ছেদ্য অংশ যে ভারতীয়-মুসলমান সম্প্রদায় মহাবিদ্রোহের সময় থেকে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদেরই এক অংশ সমাজ-রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়েছেন। মেয়র হিসেবে সুভাষচন্দ্র তাই তাঁদের জন্য উপযুক্ত চাকরির ব্যবস্থাগ্রহণে উদ্যমী হন। ইংরেজ সরকার অবশ্য প্রশাসক সুভাষকে কাজ করতে দেননি, তাঁকে বার বার জেলে পাঠিয়েছেন।
ইংরেজদের অপচেষ্টাই যে ভারতের হিন্দু-মুসলমানকে পরস্পরের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তুলেছে এই সত্য সুভাষ দেশের বাইরে থেকে বার বার জানাতে পেরেছিলেন। ১৯৪৪ সাল। টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা দিলেন তিনি। সে বক্তৃতায় অতীত ভারতের দুটি গৌরবময় পর্বকে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, ‘‘গুপ্তসম্রাটদের আমলে ভারত উন্নতির শিখরদেশে পৌঁছেছিল। ...মোগল সম্রাটদের শাসনকাল পুনরায় ভারতের এক গৌরবময় যুগ।’’ হিন্দু-পুনরুত্থানবাদীরা গুপ্ত যুগের কথা বলেন, মুঘল আমল সম্বন্ধে নীরব থাকেন। কথাগুলি আগেও সুভাষ লিখেছিলেন, আবারও বললেন। হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়ের ধারাটির কথা সব সময় মনে রাখেন, সে ভাবেই ভবিষ্যৎ ভারতের পরিকল্পনা করেন তিনি। এই বক্তৃতার দু’বছর আগে ১৯৪২ সালে স্বাধীন ভারত এবং তার সমস্যা নামে যে নিবন্ধ লিখেছিলেন তাতে ধরে ধরে ভবিষ্যৎ ভারতের আদর্শ রূপ কেমন হওয়া উচিত, তা বিশ্লেষণ করেন।
তাঁর মতে ধর্ম নয়, ভারতের ‘‘সবচেয়ে বড় সামাজিক সমস্যা হল দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব।’’ তা দূর করার জন্য ‘‘দরকার সরকারি আর্থিক সাহায্যে শিল্পায়ন ও বিজ্ঞানসম্মত কৃষিব্যবস্থা।’’
সরকারের ভূমিকা ও দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। সরকার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। এখনকার নির্বিচার অসরকারিকরণ সুভাষের সমর্থন পেত না। সুভাষের ভবিষ্যৎ ভারতে ধর্মের ভূমিকা কী হবে? তিনি লিখলেন, ‘‘রাষ্ট্রকে প্রত্যেক ব্যক্তির এবং গোষ্ঠীর ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক আচরণে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে এবং কোনও রাষ্ট্র-ধর্ম থাকবে না।’’ এই লেখাটিতেই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন তিনি, ‘‘ভারতের বর্তমান মুসলিম সমস্যা ব্রিটিশরা কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করেছে ... ব্রিটিশ শাসন অপসারিত হলে এই সমস্যা আর থাকবে না।’’
সুভাষ ঠিক ভেবেছিলেন এবং ভুল ভেবেছিলেন। ঔপনিবেশিক প্রশাসকেরাই যে তাঁদের স্বার্থ পূর্ণ করার জন্য কৃত্রিম ভাবে হিন্দু মুসলমান সমস্যা সৃষ্টি করেছিলেন এ কথা সত্য, কিন্তু সাহেবরা চলে গেলেই হিন্দু মুসলমান সমস্যা চলে যাবে সুভাষের এই ভাবনা সত্য হয়নি। হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিষ প্রয়োজন মতো স্বাধীন ভারতে রাজনৈতিক দলগুলি উস্কে তুলেছে।
সুভাষ কেবল ঘোড়ার পিঠে-চড়া সমরনায়ক নন। যুদ্ধ করতে তিনি পিছপা হননি তবে স্বাধীন যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তাই ছিল তাঁর লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা। সেই চিন্তাটুকু ভুলে গিয়ে সুভাষের ‘মুখ’ আর ‘নাম’ যেন আমরা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ব্যবহারযোগ্য উপকরণ হয়ে উঠতে না দেওয়া হয়।
বিশ্বভারতী, বাংলা বিভাগ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy