নরেন্দ্র মোদীর ভারত নিয়ে আমার শঙ্কা দেখে অনেক পাঠক আমার কাছে প্রশ্ন করছেন, মোদীর ভারত যদি নেহরুর ভারতের বহুত্ববাদী গণতন্ত্রকে এ ভাবে ধূলায় লুন্ঠিতই করে তবে মানুষ এ ভাবে তাকে কেন স্বাগত জানাচ্ছে? গণতন্ত্রে মানুষই তো সর্বদা শেষ কথা বলে, উত্তরপ্রদেশের ভোটের ফলাফল দেখেও তো বলা যাবে না যে মোদীর প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছেন। পাঠকেরা মোদীর প্রতি এই আস্থা-রহস্য জানতে আগ্রহী।
আজ শাহি সমাচারে মোদীত্বের এই সাফল্যের রসায়ন নিয়েই তাই আলোচনায় আগ্রহী।
রাজনীতি পরিবর্তনের বিজ্ঞান। ভারতের রাজনীতির অতীত দ্রুত বদলাচ্ছে। কোনও সন্দেহ নেই মোদী এক অভিনব জনপ্রিয় নেতা। তিনি ভারতীয় রাজনীতির ব্যাকরণে এক মস্ত বড় বদলও আনছেন। মানুষের সমর্থন ছাড়া এই বদল সম্ভবও নয়। আগে আমরা জানতাম রামায়ণ আর মহাভারতই শুধু ‘মাইথোলজি’। আজ কিন্তু প্রতি মুহূর্তে এই ‘মাইথোলজি’ মোদী নিজে তৈরি করছেন। মুলায়ম সিংহ যাদবকে নেতাজি বলে মানুষ, কিন্তু মোদী শুধুই মোদী। তিনি যত না প্রধানমন্ত্রী, যত না বিজেপি নেতা, তার চেয়েও বেশি নরেন্দ্র মোদী। তিনি বাম নন, তিনি ডান নন। মানুষ হতাশ। ক্লান্ত। বিগত জমানার দুর্নীতি। নীতিহীনতা। এ সবের মধ্যে মোদী এক অবতার। ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে সুপারম্যানের পোশাকে মোদীর পোস্টার দেখেছি। আজও ভারতের যে কোনও শহরে যান, সবচেয়ে বেশি পোস্টার, ছবি নরেন্দ্র মোদীর। ভারতের রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজ নানা কারণে ঐতিহাসিক ভাবে পচিত গলিত। তাই পুরনো রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ারিংগুলোতেও মরচে ধরে গিয়েছে। মোদী তাই এখন উত্তর ভারতে এক নতুন তৃণমূল আন্দোলনের জন্ম দিয়েছেন। সে এক বিচিত্র প্যাকেজ। মোদীত্বের এই রাজনীতিতেও আছে বাস্তববোধ। গ্রামীণ গরিব ভারতীয়দের স্ব-ক্ষমতা অর্জনের রাজনীতি। এ জন্য ইন্দিরা গাঁধীর যেমন ছিল ‘গরিবি হঠাও’, ঠিক তেমনই মোদীর রাজনীতি হল নোটস্থগিত করার রাজনীতি। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সমতুল্য রাজনীতি তিনি করতে চাইছেন জনধন যোজনার মাধ্যমে। সময় বদলে গেছে। নেহরু-ইন্দিরা যুগ অতিবাহিত। শক্তিশালী রাষ্ট্রভাবনার সঙ্গে তিনি মেলাচ্ছেন হিন্দু কট্টর জাতীয়তাবাদী ভাবনাকে। আর এই সব কিছুর মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠছেন এক পপুলার ভারতীয় রাজনীতিক। আর তার রাজনীতিটিও নিশ্চয়ই পপুলিজম। সম্প্রতি পড়লাম Jan Werner Muller-এর লেখা What is Populism বইটি। মুলার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক। আমেরিকা, ব্রিটেন তথা ইউরোপের পটভূমিতে তিনি পপুলিজম নামক বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন। ২০১৬ সালে প্রকাশিত বইটিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনীতি নিয়েও আলোচনা করেছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বার্নি স্যান্ডারস— দু’জনের গায়েই তকমা দেওয়া হয়েছে। বিদেশে পপুলিস্ট-কে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অ্যান্টি এস্ট্যাব্লিশমেন্ট বলে মনে করা হয়, মনে করা হয় পপুলিস্টরা হল এলিট-বিরোধী, প্রান্তিক আমজনতার পক্ষে, অনেক সময়েই রাগী, আপসী নয়। নরেন্দ্র মোদীও কি সেই ভাবে এক জন পপুলার এবং পপুলিস্ট নেতা হয়ে উঠেছেন?
রাজনৈতিক ‘পপুলিজম’ শব্দটি আমরাও আজকাল খুব ব্যবহার করি। যারা ভর্তুকি বন্ধ করে কঠিন কঠোর বৃদ্ধির অনুশাসনে না চলে সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলে, গরিব দরদী জনকল্যাণকামী ভূমিকায় জোর দেয়, যেমন ইউপিএ জমানার সনিয়া, এমনকী মনমোহন, সেটা পপুলিজম। কিন্তু প্রচলিত ধারণায় এই পপুলিজম সাধারণ মানুষের জন্য জনপ্রিয় রাজনৈতিক অগ্রাধিকার হল Left Wing, কিন্তু মুলার বলছেন, Marine Le Pen বা Greet Wilders-কেও পপুলিস্ট বলা হয়। আবার গ্রিসের সাইরিজা পার্টি (Syriza) ২০১৫ সালে ক্ষমতায় আসে লেফ্ট উইং পপুলারিজম-এর স্লোগান দিয়ে। মুলারের তাই মনে হয়েছে, আজকের রাজনীতিতে পপুলিজম-এর কথা বলাটাই পপুলিস্ট রাজনীতি।
পপুলিজম-এর রাজনীতির মধ্যে নৈতিকতার উপাদান থাকে যা মোদীর রাজনীতিতেও আছে। তার আগে জনপ্রিয় নেতা বলতে মনে করা হত হোচিমিনের মতো এক জন নেতা। যাকে দেখে মনে হবে, আরে, এ তো আমাদেরই কাকা বা জ্যাঠার মতো এক জন মানুষ! কিন্তু এমন পপুলার বা পপুলিস্ট নেতা কিন্তু সে ভাবে আমজনতার প্রতিনিধিত্ব আর করেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেও বার বার মনে হয়, এ তো আমাদেরই লোক! আমার বা আমাদের নিজস্ব স্বকীয় সত্তাকে জাগিয়ে দেয়, সংযোগ করে দেয় তার সঙ্গে। এই নেতারা হিন্দি ছবির রাজেশ-অমিতাভ বা শাহরুখের মতো স্টার নন, কিন্তু পাশের বাড়ির ছেলে বা মেয়ের মতো। হয়তো অমল পালেকর বা বিদ্যা সিনহা। কিন্তু এখন যখন ট্রাম্প জনপ্রিয় নেতা হন তখন মানুষ তাঁকে ভোট দেন, কিন্তু মনে করেন না যে তিনি ‘জাস্ট লাইক আস’। আমাদের আম বৈশিষ্ট্যের কিছু উপাদান নিশ্চয়ই তাঁর মধ্যেও আছে কিন্তু তাঁর নিজের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য এমনই যা আমাদের মধ্যে নেই, অথচ যেগুলো আমরা চাই দেশ ও সমাজের স্বার্থে। হুগো স্যাভেজের ক্যারিশমা ছিল, কিন্তু তিনিও ‘আ লিটল অফ অল অফ ইউ’ ছিলেন। মোদী তা নয়, মোদী অভিনব।
কাজেই গোটা দুনিয়াতেই আর্থিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকটে ক্লান্ত নাবিক হাল ভাঙা পালছেঁড়া পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক পপুলিজম-এর এক অভিনব পরীক্ষায় নেমেছেন। মানুষ বিশ্বাস করছেন মোদীকে, রাষ্ট্র সমাজকে ঠিক এ ভাবেই ধর্মীয় মেরুকরণের পথে নিয়ে যেতে উদ্যত মোদীর সঙ্গে থাকবে কর্মসংস্থান ও বেকারি দূরীকরণের এক নয়া রাজনীতি। অতএব, এক দিকে হিন্দু জাতিসত্তা পুনরুত্থানের চেষ্টা, অন্য দিকে অন্য রাস্তায় দুর্নীতি ও কংগ্রেসমুক্ত এক নয়া ভারতসভার চেষ্টা। কিন্তু মহন্ত আদিত্যনাথ আর রাজ্যের ও দেশের বিকাশ। এ দুটি কি স্ববিরোধী নয়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy