কূটযোদ্ধা: ব্রিকস বৈঠকে চিনের প্রেসিডেন্ট শি িচনফিং-এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদী, গোয়া, ২০১৬। এপি
পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় যা হয়ে চলেছে, তাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরাজয় বললে ভুল হয় না। কুড়ি জন ভারতীয় সেনা প্রাণ হারালেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী চিনের কাছে পরাভূত এবং অপমানিত হলেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় ‘পরাজয়’— চিনারা জোর করে সীমান্তরেখা লঙ্ঘন করলেও প্রতিবাদ করেননি প্রধানমন্ত্রী। বরং ভারতের এলাকায় কেউ ঢোকেনি, এই বলে ব্যাপারটাকে লঘু করতে চেয়েছেন। মোদীর এই দাবিতে তাঁর অনেক একনিষ্ঠ সমর্থকও চমকে গিয়েছেন এ বার। মোদীর অতিমানবীয় ভাবমূর্তি— তিনি সমস্ত শত্রুকে দারুণ শিক্ষা দিতে পারেন— সত্যিই চুপসে গিয়েছে।
তাঁর নিন্দুকেরা খুশি। সমর্থকেরা চেষ্টা করছেন বার্তা-পরবর্তী নীরবতার সদর্থক দিকটা দেখতে। এই নীরবতা কিন্তু আগে দেখা যায়নি। বালাকোট অপারেশনের পরে দম্ভের দাপট ভোলেননি কেউ। এ বারে কিন্তু সেটা লক্ষণীয় ভাবে অনুপস্থিত। এখন দেশপ্রেম বলতে টিকটক অ্যাপ
বাতিল, সেকেন্ড-হ্যান্ড চিনা টিভি ভাঙা, এই সব। বিজেপি-র কিছু গণ্যমান্য সদস্য চিনা রেস্তরাঁগুলোও বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। অবশ্য তাদের প্রত্যেকটাই চালান ভারতীয়রা, এবং সেখানে যে খাবার পাওয়া যায় তার সঙ্গে চিন দেশের কোনও পদের সামান্যতম মিলও নেই। ঔদ্ধত্য এবং অজ্ঞতার উপর ভর করে চলছে এই সব কিম্ভূতকিমাকার ভাবনাচিন্তার জয়জয়কার।
কূটনীতিকে জনসংযোগের খেলা মনে করাটা অত্যন্ত শিশুসুলভ আচরণ। আলিঙ্গন, বর্ণাঢ্য অভ্যর্থনা, বিপুল ভোজসভা এবং বাগাড়ম্বর কখনও ভূ-রাজনৈতিক পদক্ষেপের পরিবর্ত হতে পারে না। কূটনীতির বর্তমান বা সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে ঠিক দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি আমলা বা পুলিশের মতো করে ‘সামলে নেওয়া’ যায় না। ঠান্ডা মাথায় হিসেব করা কূটনীতির কৌশলী চালকে কখনওই নাট্যশালার কেরদানি দিয়ে আটকানো যায় না।
ভূ-রাজনীতির বিষয়টা ব্যক্তিগত ইমেজ বা ব্যক্তিমানুষের ঊর্ধ্বে। খুব কম নেতাই পারেন ইতিহাসের গতি পাল্টে দিতে। আর যাঁরা পারেন তাঁরা জানেন ক্ষমতা কী করে ব্যবহার করতে হয়। জ্ঞান, বৈদগ্ধ্য এবং বিবেচনা তাঁদের অনেক। অন্য দিকে, মোদী কূটনীতিকে প্রায় নাট্যাভিনয়ের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। মজার কথা, যে ব্যক্তিকে তিনি বর্তমান ভারতের বেশির ভাগ সমস্যার জন্য দায়ী করেন, সেই প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মতোই আচরণ করছেন তিনি এ ক্ষেত্রে।
বিরাট ভুল করেছিলেন নেহরু। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে নির্জোট আন্দোলনের বাক্যালঙ্কার দিয়েই আলোচনার টেবিলে দুই সদ্য-স্বাধীন জাতি ভারত ও চিনের বহু যুগের বিদ্বেষ মুছে দিতে পারা যাবে। তাঁরও মনে হয়েছিল— করমর্দন, সরকারি সফর এবং উষ্ণ আলিঙ্গনের মাধ্যমেই ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংক্রান্ত বিরোধ মিটিয়ে নেবে চিন। এর পর চিন যখন ভারত সীমান্তে আক্রমণাত্মক কাণ্ডকারখানা শুরু করল, নেহরু তখন তাঁর হীনবল সেনাকে শক্তিশালী না করে আরও উস্কানি তৈরি করে ফেললেন। তারই ফল ১৯৬২ সালের
ভারত-চিন যুদ্ধ, যে যুদ্ধের লজ্জাজনক পরাজয় থেকে কখনওই আর রাজনৈতিক ভাবে মুক্ত হতে পারেননি নেহরু, স্বাস্থ্যের দিক থেকেও তাঁকে চেপে ধরেছিল গ্লানি। মোদী অবশ্য শেষ মুহূর্তে খাদের কিনারা থেকে পিছিয়ে এসেছেন। কিন্তু এ ছাড়া প্রায় নেহরুর মতোই আচরণ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীরও। ক্ষমতায় আসার আগে বড় গলা করে তিনি বলেছিলেন, ভারতকে সেনাশক্তিতে এমনই অপরাজেয় করে তুলবেন যে কোনও আগ্রাসী শক্তিই আর ভারতের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার সাহস পাবে না। বাস্তবে ঠিক তার বিপরীতটাই ঘটেছে।
যে ছয় বছর তিনি ক্ষমতায় আছেন, সেই সময়ের মধ্যে ভারতীয় বায়ুসেনা নেমে এসেছে ৩১ স্কোয়াড্রনে, যেখানে প্রয়োজন ৪৫ স্কোয়াড্রন। অত্যাধুনিক রণনীতিতে বায়ুসেনাই সবচেয়ে জরুরি শাখা। ভারতীয় বায়ুসেনার ১২৬টি ‘স্টেট অব দি আর্ট’ বা অাধুনিক কমব্যাট ফাইটার যুদ্ধবিমান দরকার। মাত্র ৪০টি দিতে পেরেছেন মোদী।
এর চেয়েও খারাপ কথা, সেনাবাহিনীর অস্ত্রভান্ডারে বিপুল ঘাটতির রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। এ বছরের মার্চে, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির এক বৈঠকে ভারতীয় সেনার প্রতিনিধিরা সতর্ক করেন যে পাকিস্তান ও চিনের সঙ্গে যুগপৎ যুদ্ধের সম্ভাবনা যথেষ্টই ‘বাস্তব’, এ দিকে সেনার ক্ষমতায় বিরাট ফাঁক থেকে গিয়েছে। তা অত্যন্ত দ্রুত পূরণ করা দরকার। প্রতিনিধিরা সংসদীয় প্যানেলকে এ কথাও খুব স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন যে দশ দিন যুদ্ধ করার মতো অস্ত্রভান্ডার মজুত রাখার ক্ষেত্রে যে প্রয়োজনীয় অর্থভান্ডার চাই, সেই ৬৩৮০ কোটি টাকার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। সরকারের নড়েচড়ে বসা উচিত ছিল। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ কথা এখন পরিষ্কার যে গালওয়ান উপত্যকার ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগেই কেন্দ্রীয় সরকার জানত যে চিনা সেনা পূর্ব লাদাখের পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছে। সম্প্রতি এক অনলাইন বিবৃতিতে বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেছেন, মে মাসের গোড়ার দিকে গালওয়ান উপত্যকায় ভারতের ‘স্বাভাবিক, নিয়মমাফিক’ টহলদারি ব্যাহত করার চেষ্টা করেছিল চিনা সেনা। মে মাসের মাঝামাঝি থেকেই পশ্চিম সেক্টরের অন্যান্য এলাকাতেও স্থিতাবস্থা নষ্ট করতে তৎপর হয়েছিল চিন। ভারত সরকার তার উত্তরে যেটুকু করেছিল, তা ছিল কূটনীতি ও সামরিক সূত্রে কিছু নিষ্ফল প্রতিবাদ। অর্থাৎ চিনের উদ্দেশ্য বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল ভারতীয় নেতৃত্ব। পূর্ব লাদাখে চিনেক ‘স্ট্র্যাটেজিক’ বা বৃহৎ কৌশলগত পদক্ষেপ আটকাতে কেবল ‘ট্যাকটিকাল’ বা খুচরো পাল্টা হিসেবের কথাই ভেবেছিল ভারত। কূটনীতির ব্যাকরণ মানলে, এই ঘটনাকে ভারতের বিরাট ব্যর্থতা বলতে হবে।
নড়েচড়ে বসা হল গালওয়ান ঘটনার পর। সামান্য হলেও সেনাবাহিনীর চাহিদা পূরণের কথা ভাবল সরকার। শোনা যাচ্ছে, পর্যাপ্ত অস্ত্রভান্ডারের জন্য একাধিক অস্ত্র সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। রাশিয়া সফরে গিয়ে সে দেশের বার্ষিক সেনা কুচকাওয়াজে উপস্থিত রইলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। জরুরি ভিত্তিতে মিসাইল, অ্যাসল্ট রাইফেল-সহ নানা অস্ত্র সরবরাহের আবেদন করলেন তিনি। কিন্তু অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। ক্ষতি হতে কিছু বাকি নেই।
পাক-অধিকৃত-কাশ্মীরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং বালাকোটে সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ ছিল ট্যাকটিকাল বা খুচরো হিসেবি পদক্ষেপ, যার ফলে শত্রুপক্ষকে ‘রাজনৈতিক’ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং অপমানিত করা যায়। সফল হলেও তাতে কূটনীতির কৌশলের অঙ্ক কিছু পাল্টানো যায়নি। চিনের বিরুদ্ধে এই ধরনের অপারেশনে কোনও ফলই হওয়ার আশা নেই। কেননা কয়েক জন চিনা সেনাকে হত্যা করলে কিংবা শিনচিয়াং-এর কোনও প্রত্যন্ত আউটপোস্ট উড়িয়ে দিলেও বেজিং-এর আসলে সামান্যতম কিছু এসে যাবে না, চিনের কূটনৈতিক কৌশলে কোনও পরিবর্তন আসবে না। ইতিহাস আমাদের বার বার শিখিয়েছে যে সামরিক শক্তি দিয়েই হঠকারী সামরিক আক্রমণ ঠেকানো যায়। দুর্বলতার গন্ধ থাকলেই তা সম্ভাব্য আগ্রাসী শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। আজ দেশের সীমান্তের সংবাদ— চিনা সেনার পিছিয়ে যাওয়ার কোনও পরিকল্পনাই নেই। স্পষ্ট চিহ্নবিহীন, দুর্বল সীমান্তে একের পর এক পরিকাঠামো তারা তৈরি করেই চলেছে। প্যাংগং ৎসো লেকের চার পাশের অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে শক্তি বাড়িয়েছে। ২৬ জুন ওই এলাকায় তাদের বায়ু ও স্থলসেনার এক বিশাল যৌথ মহড়া আয়োজিত হয়েছে। এ দিকে বেজিং-এর অনধিকার প্রবেশের ঘটনাকে মোদীর তাচ্ছিল্য করা দেখে খুশিই হয়েছে চিনা কমিউনিস্ট নেতৃত্ব। মনে করছে, ঠিক রাস্তাতেই চলছে তারা।
ভারতের পক্ষে একমাত্র ভাল খবর হল বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপট। ইদানীং একের পর এক বড় এবং সদম্ভ পদক্ষেপ করছে বেজিং: দক্ষিণ চিন সাগরে, পূর্ব লাদাখে, হংকং-এ। কিন্তু এর ফলে বড্ড বেশি শত্রুও তৈরি করে ফেলছে তারা। ভারতের মতো বৃহৎ আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে অকারণ শত্রুতা তৈরি করা নির্বুদ্ধিতারই প্রকাশ। মোদী এই স্পর্ধিত বেজিংকে ক্ষমা করবেন না কখনও। যত দিন তিনি শাসন করবেন, কোনও না কোনও ভাবে এর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে যাবেন।
আসল কথা, ক্ষমতার দম্ভই যে পতনের শ্রেষ্ঠ পথ, ইতিহাস বহু বার দেখিয়ে দিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy