Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
কাশ্মীরের রাজনীতি আর কাশ্মীর নিয়ে রাজনীতির বাইরে

ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি

হামিদ আমার চেনা কোনও মানুষ নয়। মহম্মদ হামিদ ভাটের নাটক ‘ফোন নম্বর ৭৮৬’ অবলম্বনে তৈরি সিনেমা ‘হামিদ’-এর মুখ্য চরিত্র। সিনেমার চরিত্র হয়েও হামিদ আমার খুব চেনা।

সোমেশ্বর ভৌমিক
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

আট বছরের কাশ্মীরি বালক হামিদ বাবাকে দেখেনি, বেড়ে উঠছে দুঃস্থ মায়ের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু মায়ের স্নেহ, প্রশ্রয় এ সবও ঠিক জোটে না তার। মা বলেন, ওর বাবা আল্লার কাছে গিয়েছেন। সেই আল্লার কাছে পৌঁছনোর খুব শখ তার। পবিত্র সংখ্যা ৭৮৬-এর মানে জিজ্ঞেস করলে, মা বলেন ৭৮৬ হল আল্লার নম্বর। কোচিং ক্লাসের বিজ্ঞাপনে মোবাইল নম্বরের কায়দা (৯-১২৩-১২৩-১২৩) কাজে লাগিয়ে ৯-৭৮৬-৭৮৬-৭৮৬ নম্বরে ফোন করে হামিদ। শুরু হয় বহিরাগত সশস্ত্রবাহিনীর এক পোড়খাওয়া সদস্যের সঙ্গে তার এক অদ্ভুত সম্পর্ক। সম্পর্কের বেশিটাই ভয় আর অবিশ্বাসে ভরা। টানাপড়েনের বাইরে তাতে কখনও-সখনও যোগ হয় বন্ধুত্বেরও মাত্রা। অশান্ত কাশ্মীরকে নিয়ে দুটো সমান্তরাল পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়— তাদের দু’জনের দেখার সূত্রে। সেই কাশ্মীর, যার ভূস্বর্গ নামটিকে ব্যঙ্গ করেই দুই কিসিমের বন্দুকের নিশানায় প্রতি দিন ব্যাহত, বিপর্যস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষের আটপৌরে জীবন।

হামিদ আমার চেনা কোনও মানুষ নয়। মহম্মদ হামিদ ভাটের নাটক ‘ফোন নম্বর ৭৮৬’ অবলম্বনে তৈরি সিনেমা ‘হামিদ’-এর মুখ্য চরিত্র। সিনেমার চরিত্র হয়েও হামিদ আমার খুব চেনা। কাশ্মীরি মহিলা সহকর্মী তাঁর ওই বয়সেরই ছেলের গল্প শুনিয়েছিলেন আমায়। তাঁদের পরিবার যথেষ্ট সম্পন্ন। তবু তিনি আমায় শুনিয়েছিলেন সারা দিন কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পর ঘরবন্দি ছেলের প্রশ্নের ফিরিস্তি। সেই সব প্রশ্নের মধ্যে গেঁথে থাকে ভয় আর উদ্বেগ। মূল প্রশ্ন হল, তার বাবা দাদা কাকার মধ্যে কেউ কোনও দিন হঠাৎ হারিয়ে যাবে না তো?

হামিদ তাই কাল্পনিক চরিত্র হয়েও এক সর্বব্যাপী বাস্তবের আধার। এই আধার নির্মাণের প্রক্রিয়াকেই তো এক সময় শিল্পের ভাষায় বলা হয়েছে বাস্তবতাবাদ। ভাল লাগছে ভেবে, উত্তর-আধুনিকতার যুগেও তার রেশ রয়ে গিয়েছে। তাই লেখা হল ‘ফোন নম্বর ৭৮৬’-এর মতো নাটক, তৈরি হল ‘হামিদ’-এর মতো ছবি। অবশ্য সে-নাটক বা এই ছবি ক’জন দেখেছেন, তাতে সন্দেহ আছে আমার।

কাশ্মীর নিয়ে সিনেমা বলতে এককালে আমরা বুঝেছি ‘কাশ্মীর কি কলি’, ‘জংলি’, ‘ববি’ বা ‘রোজা’-র মতো ছবি, যেখানে কাশ্মীর মূলত দৃশ্যের শোভাবর্ধক নিসর্গ— চরিত্রগুলো নিখাদ ‘ভারতীয়’। সাম্প্রতিক কালে কাশ্মীর নিয়ে সিনেমার তালিকায় ‘গৌরবজনক উপস্থিতি’ বলতে ‘হায়দর’, বা ‘উরি— দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক’। কাশ্মীরের যে মন আছে, আত্মা আছে, নিজস্ব ঐতিহ্য আছে, তার প্রমাণ ক্বচিৎ পাওয়া গিয়েছে এ সব ছবির আখ্যানে। অথচ সংবিধানের ৩৭০ বা ৩৫ক ধারা বা আফস্পা নামের এক নির্মম আইনের যৌক্তিকতা নিয়ে রাজনৈতিক তরজার ভাষাগত দূষণের বাইরে, যুযুধান দুই পক্ষের মরণপণ রেষারেষির তীব্র জেদের উপস্থাপনা ছাড়িয়ে বাস্তব-নির্ভর আধার নির্মাণের একটা ধারা তৈরি হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে। সেই ধারার ছবি ‘তাহান’ শোনায় হামিদের বয়সি একটি ছেলের গল্প যে তার প্রিয় গাধাকে মহাজনের হাত থেকে ছাড়ানোর জন্যে নানা কিসিমের ঝুঁকি নিতেও তৈরি; ‘সিকান্দার’ তুলে আনে ফুটবল-পাগল এক কিশোরের গল্প, যে জঙ্গিদের হাতছানি উপেক্ষা করে মেতে থাকে ফুটবল সাধনায়; ‘হারুদ’ তুলে ধরে কিশোর রফিকের গল্প, যে তার হারিয়ে যাওয়া দাদার ক্যামেরা খুঁজে পেয়ে জড়িয়ে পড়ে নিষিদ্ধ অ্যাডভেঞ্চারে। যে মানুষরা কাশ্মীর বলতে কেবল ডাল লেক, পহেলগাম, গুলমার্গ আর চিনার বোঝেন, যে রাজনীতিকরা কথায় কথায় গলার শির ফুলিয়ে বলেন, কাশ্মীর হল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাঁদের কত জন চেনেন সমাজের তথাকথিত এই সব গৌণ চরিত্রকে, তাঁদের কষ্টকে? আমরাও কি চিনি? কারণ, এ সব ছবি সচরাচর আমাদের চোখে পড়ে না।

যেমন পড়ল না সাম্প্রতিকতম ছবিটি, যা আমাদের কাছে কাশ্মীরের কষ্টের কথা বয়ে আনে—‘নো ফাদারস্‌ ইন কাশ্মীর’ (সঙ্গে তার একটি দৃশ্য)। ছবির কেন্দ্রে আছে দুই কিশোর চরিত্র। প্রথম জন, নুর নামের কাশ্মীরকন্যা, তার মায়ের হাত ধরে লন্ডন থেকে এসে পৌঁছয় শ্রীনগরে, ঠাকুরদা-ঠাকুরমার বাড়িতে। মা তাকে বলেছিলেন, তার বাবা তাদের ছেড়ে নিরুদ্দেশ। এই মিথ্যের আবরণ ভেদ করে অন্য এক ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি হতে থাকে নুর। সেই সত্যের পথে তার সঙ্গী স্থানীয় কিশোর মাজিদ। তার বাবাও নিখোঁজ। যদিও মাজিদ তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না, নুরের জেদ আর অদম্য কৌতূহল তাকেও প্রভাবিত করে। ঘটনার জটিল আবর্তে জড়িয়ে পড়ে তাদের দুই মা, নুরের ঠাকুরদা-ঠাকুরমা, গ্রামের মাদ্রাসার শিক্ষক। সেই আবর্তের নিয়ন্তা রাষ্ট্র, এবং রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী। সেই বাহিনীর নেতার কাছে মানবিকতার দোহাই দিলে তিনি পলক না ফেলেই বলে দেন, কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ একই সঙ্গে আমার দেশবাসী, আবার আমার শত্রু। এই উক্তির অন্তর্নিহিত কাঠিন্যের ভার যেমন বুকের ওপর চেপে বসে, তেমনই এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসহায়তার সুরটাও দর্শককে ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। বক্তা উর্দিধারী, কঠোর অনুশাসনের দাস, রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ, কর্তব্যপালনে হিংস্রতার আশ্রয় নিতেও পিছপা নন। অথচ তাঁর কর্তব্যবোধ মনের মধ্যে যে প্রবল টানাপড়েনের জন্ম দেয়, তাকে তিনি এড়াতে পারেন না।

একই পরিণতি তাঁর ঘোষিত শত্রু আরশিদেরও। আপাতদৃষ্টিতে তিনি কাশ্মীরের বুকে স্থাপন করতে চান জেহাদ-জাত, ইসলাম-মান্য এক পবিত্রভূমি। কিন্তু সেটা তাঁর বাইরের রূপ। ভেতরে ভেতরে তিনিও অসহায়। প্রবল অত্যাচারের মুখে ভেঙে পড়ে নিজের ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধুকে ‘নিরাপত্তা বাহিনী’-র হাতে তুলে দেওয়ার পরে শুধু প্রাণে বেঁচে থাকার একটা মানে তৈরি করার জন্যেই তাঁকে ভেক ধরতে হয়, আবার রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে গোপন বোঝাপড়াতেও জড়িয়ে পড়তে হয়। অন্য দিকে নিজেদের ক্ষতি, নিজেদের অসহায়তার ধিকিধিকি আগুনকে উপেক্ষা করেই ঘরে-বাইরে যা ঘটে চলেছে তাকে শান্ত চিত্তে গ্রহণ করার সঙ্কল্প করেছেন নুরের ঠাকুরদা-ঠাকুরমা। তাকে নিয়তিবাদ বলে উপেক্ষা করতে গিয়েও থমকে যেতে হয় তাঁদের মুখের সংলাপ শুনে। মা-র তৈরি করা মিথ্যেটাকে ধরে ফেলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাছে প্রায় কৈফিয়ত চাওয়ার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে নুর। জবাবে বৃদ্ধা বলেন, কচি মনে যাতে চিরস্থায়ী ক্ষত তৈরি না হয়, এ সব তো তারই জন্যে। আর বৃদ্ধ সস্নেহে নাতনিকে বলেন, সবার সব ‘অপরাধ’-এর প্রতিশোধ নিতে হলে অন্যের সঙ্গে তোমার তফাতটা কোথায়? এই ভাবে কাশ্মীরের পুরনো সুফি ঘরানার দুই প্রতিভূ আমাদের মনে করিয়ে দেন, মনই হোক মানুষের আসল পরিচয়, আত্মা হোক তার ধারক।

ছবিতে প্রতিটি চরিত্রই কোনও না কোনও দ্বন্দ্বের শিকার। ফলে কালো-সাদা, ভাল-মন্দের সরল ধাঁচায় তাদের চিহ্নিত করা যাবে না। গ্রিক ট্র্যাজেডির চরিত্রদের মতো তারা কোনও দৈব অভিশাপ, পূর্বনির্দিষ্ট নিয়তির ভার, অথবা তীব্র আর্তি নিয়ে হেঁটেচলে বেড়ায় না। শুধু ঘটমান বর্তমানের জটিলতা ধীরে ধীরে তাদের গ্রাস করে। বদলে দেয় তাদের জীবন, জীবনবোধ।

কাশ্মীরের কত রকম পরিচিতি তৈরি হয় একটি ছবির সূত্রে। সুফিমতের সেই যে ধারণা, যার কেন্দ্রে আছে প্রকৃতি আর মানুষের সহাবস্থান, মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক, তা অন্তঃসলিলার মতো বয়ে চলে ছবিতে। অবশ্য, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর মনে হয়, এই মতের কোনও প্রাসঙ্গিকতাই আজ আর তাঁদের জীবনে নেই। আবার যে কাশ্মীর নিয়ে অখণ্ডতাবাদী ক্ষমতাসীনদের এত দরদ, তাকে তাঁরাই পরিণত করেছে শত্রুভূমিতে। এই তিনের সম্মিলনে যে কোলাজটি তৈরি হয়েছে, তার তাৎপর্যকে বাঁধা যাবে না সংবিধানের ৩৭০ বা ৩৫ক ধারার গণ্ডিতে। ছবির কোনও চরিত্রই এই বলে গর্জে ওঠে না যে, ‘‘এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ না।’’ তবু ছবির পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে তাদের দীর্ঘশ্বাস, অসহায়তা, আর ব্যথা। সেখানেই ছবির জোর।

সেই ব্যথার কথা তুলে আনার দাম গুনতে হয়েছে পরিচালক অশ্বিন কুমারকে। মানুষের ব্যথা-বেদনার হিসেব নিতে রাষ্ট্রের বয়েই গিয়েছে, বিশেষত নারী আর শিশুদের বেদনা। রাষ্ট্র শুধু চায় তার পছন্দসই পৌরুষ-নির্ভর বয়ানের উপস্থাপনা। তা থেকে বিচ্যুতির শাস্তি হিসেবে রাষ্ট্র এই ছবিকে ছাড়পত্র দিতে টালবাহানা করেছে মাত্র নয় মাস!

অন্য বিষয়গুলি:

Kashmir Article 370A Hamid
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy