আনাজের বাজারে সে দিন চোখ আটকে গেল একটা জিনিসে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ‘বহু যুগের ও পার হতে’ আষাঢ়ের ভেলায় চড়ে হাজির হল একটা ফটফট আওয়াজ। সকাল থেকেই ইলশেগুড়ি। এ বার কি মনের ভিতরেও শুরু হল স্মৃতির বর্ষণ! ছবির মতো সামনে চলে এল কত কত বাদলবেলা। মনে পড়ল, বর্ষার দিনে কী মুখরোচক খাবারই না ছিল এটা! উনুনে দিয়েই অপেক্ষা কখন ফাটবে। ফাটা মানেই পোড়ার কাজ শেষ। এ বার সাঁড়াশি দিয়ে নামিয়ে খাওয়ার পালা। পোড়া কাঁঠালবিচির সে কী অমৃত স্বাদ!
জ্যৈষ্ঠমাসে ফুরিয়ে যাওয়া কাঁঠালের রেশ তখন পুজোর আগে পর্যন্ত রেখে দিত ঝুড়িভর্তি কাঁঠালবিচি। শুধু কি পোড়া? রন্ধনপটু মা-জেঠিমা-কাকিমারা কাঁঠালবিচির সঙ্গে ডাঁটা আর হেনতেন মিশিয়ে তৈরি করতেন সুস্বাদু সব রান্না। অভাবি সংসারে ঝাড়া দু’-তিন মাস কাঁঠালের বিচি আলুর বিকল্প হয়ে ঢেকে দিত গরিব বাবা-মায়ের অক্ষমতার চিহ্ন। দুপুরের পাতে কাঁঠালের বিচির এমন পরিত্রাতার ভূমিকায় আমরা কি কিঞ্চিৎ হীনমন্যতায় ভুগতাম?
হয়তো। বহু কাল পরে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে ‘রবিফোড়ন’-এ অমলাশঙ্করের লেখা পড়ে বুকে বল পেয়েছিলাম। অমলাশঙ্কর তাঁর ছোটবেলায় আলুর বিকল্পে কাঁঠালের বিচি সহযোগে, ঘি দিয়ে লাল চালের ফেনাভাত খাওয়ার গল্প শুনিয়েছিলেন। ওখানে ছিল কাটোয়ার ডাঁটা আর কাঁঠালের বিচি দিয়ে ইলিশের পাতলা ঝোল তৈরির কথাও।
মাটির দাওয়ায় বসে অবিশ্রান্ত বর্ষার দিকে তাকিয়ে থাকা সেই হারানো ছেলেবেলায় কাঁঠালের বিচি পোড়ানোর জন্য উনুন ছিল, আঁচ ছিল, কয়লা ছিল। ছিল আরও একটা জিনিস। ছাই। শুধু মাছ কোটা বা বাসন মাজা নয়, ছাই তখন আমাদের হাজারও কাজের জিনিস। হয়তো সে জন্য স্কুলের তাৎক্ষণিক বক্তৃতাতেও তখন জায়গা করে নিত ‘ছাই’। আর তা নিয়ে বলতে উঠে গ্রামের চঞ্চল কিশোরটি বলে বসে সত্যি কথাটাই— ‘ছাই দিয়ে দাঁত মাজা হয়।’ শিক্ষকমশাই হাসেন। কথা থামলে বলেন, ‘লাভা’ ‘শোভা’ হরেক মাজন রয়েছে বাজারে। দামও বেশি নয়। মাকে কিনে দিত বোলো।’
বর্ষাকাল এলে এই ছাই ছিল আমাদের মূর্তিমান বিপদতারণ। পিছল উঠোনে মায়েরা ছড়িয়ে দিতেন ছাই। আছাড় খাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেত শিশু থেকে বয়স্ক সবাই। এখন ঘরে ঘরে গ্যাস। ছাই তার সব কাজ শেষ করে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। উঠোন পিছল হওয়ারও আর ভয় নেই। ওখানে রাশি রাশি সরিষা, কলাই জমা করার দিন যেমন গিয়েছে, তেমনি কানাই বলাই-এর বংশধরদের মধ্যেও শতভাগ হয়ে গেছে উঠোনটা। ওটাকে আর উঠোন বলেই চেনা দায়।
ছাই-ঘেরা সেই ছেলেবেলায় এক বাদল দিনে পড়ে ফেলেছিলাম বিমল মিত্রের প্রথম উপন্যাস ‘ছাই’। বর্ষায় ছাইয়ের ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে উপন্যাসের প্রসঙ্গ যখন উঠল, তখন আর এক বার দেখে নেওয়া যাক বিখ্যাত উপন্যাসের সেই বর্ষা-বর্ণনা। ‘দুই একদিনে ঘনীভূত বর্ষা নামিল। হু হু পুবে হাওয়া-খানাডোবা সব থৈ থৈ করিতেছে- পথেঘাটে এক হাঁটু জল, দিনরাত সোঁ সোঁ, বাঁশ বনে ঝড় বাধে- বাঁশের মাথা মাটিতে লুটাইয়া পড়ে…।’ আর তার পরেই সেই বর্ষার রাতে আমরা শুনি ‘পাশ ফিরে শো তো দুগগা, বড্ড জল পড়চে-একটু সরে পাশ ফের দিকি।’ শুধু কি তাই? এ সময় ‘হুড়ুম করিয়া বিষম কী শব্দ হয়, সর্বজয়া তাড়াতাড়ি দুয়ার খুলিয়া বাহিরের দিকে উঁকি মারিয়া দেখিল-বাঁশবাগানের দিকটা ফাঁকা ফাঁকা দেখাইতেছে- রান্নাঘরের দেওয়াল পড়িয়া গিয়াছে।’
সেই অঝোর বর্ষার পরে শরতের রোদ উঠল এক দিন। কিন্তু, ‘দুর্গা আর পৃথিবীর আলোয় চোখ চাহিল না।’ আমাদের কৈশোর নামক স্টেশনটার ডিসট্যান্ট সিগন্যালখানা হয়তো এখন অস্পষ্ট। তবু কে ভুলতে পারব, ‘ঘন বর্ষার রাতে, অবিশ্রান্ত বৃষ্টির শব্দের মধ্যে, এক পুরোনো কোঠায়, অন্ধকার ঘরে, রোগশয্যাগ্রস্ত এক পাড়াগাঁয়ের গরীবঘরের মেয়ের কথা’ পড়ে আমাদের সেই দীর্ঘক্ষণ চুপ করে বসে থাকা!
বর্ষা মানেই গান। সে দিনও, আজও। আর বর্ষার গান মানেই রবীন্দ্রনাথ। সেরা গান কোনটা? এমন প্রশ্নের জবাব হয় না। তবুও বৃষ্টিটা জোরালো হলে, হেমন্ত বা অরবিন্দ বিশ্বাসের গলায় ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ এক বার না শুনে কি থাকা যায়? সত্তর-আশির ছেলেবেলা মানেই আকাশবাণী। তবে দুঃখ একটাই, মেঘ গর্জালে রেডিয়োটাও থেমে থাকত না, আওয়াজ তুলত। এরই মধ্যে ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ শান্তিদেব ঘোষ বা সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে শুনে নিয়ে দেখতাম বাড়ির সামনের জল থইথই খেলার মাঠটা কখন হয়ে উঠেছে ময়নাপাড়ার মাঠ।
শুধু কি তাই? ওই রেডিয়োর ঘড়ঘড় আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকেই সুবিনয় রায় তাঁর সুরেলা গলায় ‘মেঘের পরে মেঘ’ জমিয়ে চারপাশটাকে আরও ‘আঁধার করে’ আনতেন। পুরনো শিল্পীর গলায় ওই সব রবীন্দ্রসঙ্গীত এখনও রেডিয়োতে শোনা যায়। আর ইউটিউবে ওঁদের পাওয়া তো খুবই সহজ। বর্ষার দিনে ইন্টারনেট কাজ করলে, এই সব গান দিয়ে আজও বর্ষাযাপন করা যায়।
এখন তো আবার ‘কভারে’র যুগ। রবীন্দ্রসঙ্গীতও ঠিক ভাবে না গেয়ে একটু এ দিক-সে দিক করে গেয়ে নাম দেওয়া হয় ‘কভার’। ‘কভারে’ অনেকেরই আপত্তি থাকতে পারে। যাঁদের ছুঁৎমার্গ নেই তাঁরা এই বর্ষায় পুরনো শিল্পীদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি বাংলাদেশের তরুণ গায়ক মাহতিম সাকিবের গলায়, ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ শুনে স্বাদ পাল্টে নিতে পারেন। তবে যে পরিপার্শ্বে ও মানসিকতায় এই সব কথা, সুর প্রাণ পেয়ে এক কালে ডানা মেলত কালের নিয়মেই হারিয়ে গিয়েছে তা। গানের আবেদন কিঞ্চিৎ ফিকে লাগলে তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বর্ষা মানে যদি কোন সুদূর থেকে ভেসে আসা কিছু গান বা শব্দের আনাগোনা হয়, তবে সেখানে একটা অবলা জীবের গলাও কিন্তু আসবে। গাঁ-গঞ্জে তখন অনেকের বাড়িতেই তারা পোষ্য। মেঘলা দিনে ঘর থেকে এই অবলা জীবের গলা শুনেই সে সময় আমরা বুঝতাম, শুরু হয়ে গিয়েছে বৃষ্টি। কিন্তু খুঁট উপড়ে ওদেরকে ডেরায় পৌঁছে দিতেই অনেক সময় থেমে যেত বৃষ্টিটা। ওদের চারণভূমি ছাড়ানোর জন্য এই বৃষ্টি একটা নামও পেয়েছিল— ‘ছাগল তাড়ানো বৃষ্টি’!
লেখক শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy