—ফাইল চিত্র।
এক বাণে অনেকগুলো নিশানা ভেদ করতে চেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সম্ভবত পেরেওছেন। জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ভারতে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের কাজ যে শুরু হবে, সে আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ভারত সফর যাতে শুধু বুলেট ট্রেন প্রকল্পের শিলান্যাসে সীমাবদ্ধ না থাকে, তা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক স্তরে অনেক প্রস্তুতি সেরে নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। আন্তর্জাতিক মহলের সামনে তাই ভারত-জাপান মৈত্রীর এক অভূতপূর্ব ছবি তুলে ধরা গেল এ বারের দ্বিপাক্ষিক কর্মসূচি থেকে। ভারতের আন্তর্জাতিক বলয়ের দৃঢ়তা যে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়ছে, তা আরও একবার বুঝিয়ে দিয়ে উত্তরের এবং পশ্চিমের প্রতিবেশীকে সুস্পষ্ট কূটনৈতিক সতর্কবার্তা পাঠিয়ে দেওয়া গেল। বিধানসভা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে থাকা গুজরাতকে এত বড় আন্তর্জাতিক কর্মসূচি এবং ভারতের প্রথম বুলেট ট্রেন প্রকল্প উপহার দিয়ে লহমায় অনেকখানি হাওয়া টেনে নেওয়া গেল বিজেপির পালে। কিন্তু এত তৎপরতার পরেও নিষ্কলঙ্ক, নিষ্কণ্টক রাখা গেল না গোটা আয়োজনটাকে। দেশের অভ্যন্তরীণ পরিসরে গুচ্ছ প্রশ্নের সম্মুখীন হল বুলেট ট্রেন প্রকল্প। বিরোধী দল কংগ্রেস তো বটেই, শরিক দল শিবসেনাও তীব্র কটাক্ষে বিঁধল নরেন্দ্র মোদীর সাধের প্রকল্পকে। সাধারণ জনপরিসর থেকেও শ্লেষের সুর শোনা গেল ইতিউতি। ঘরটা আর একটু গুছিয়ে নিয়ে কাজে হাত দিলে, এই অস্বস্তিটার মুখে সম্ভবত পড়তে হত না প্রধানমন্ত্রীকে।
শিনজো আবেকে পাশে নিয়ে নরেন্দ্র মোদী বুলেট ট্রেন প্রকল্পের সূচনা করলেন। শিনজো আবে ভারত-জাপান মৈত্রীর অপরিসীম গভীরতার কথা বললেন। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমে সচেষ্ট যে চিন, মোদী-আবে সেই চিনকে বুঝিয়ে দিলেন, ভারত-জাপান হাত মিলিয়ে রুখবে যে কোনও আগ্রাসনের চেষ্টা। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু-আস্ফালনের বিরুদ্ধে কঠোরতর বার্তা দেওয়া হল। জইশ-লস্করের মতো পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে যৌথ লড়াই ঘোষণা করা হল। মুম্বই এবং পঠানকোটে নাশকতার নেপথ্যে যারা, তারা যে পাকিস্তানেরই এবং তাদের বিরুদ্ধে যে পাকিস্তানকে পদক্ষেপ করতেই হবে, সে কথা ভারত-জাপান এক সুরে বলল।
আরও পড়ুন: মোদী-আবের ‘বুলেট’ জোট, যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্ট বার্তা চিন-পাকিস্তানকে
অর্থাৎ, এক দিকে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্পের উড়ান শুরু হল। অন্য দিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের অবস্থান আরও শক্ত হল। আর এই সামগ্রিক অর্জন দেশের তথা ভোটমুখী গুজরাতের শাসক দল বিজেপিকে অনেকখানি রাজনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দিল।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, শিনজো আবের সফরসূচির সবচেয়ে চর্চিত বিষয় ছিল বুলেট ট্রেন প্রকল্পের শিলান্যাস। সেই কর্মসূচিকে ঘিরেই যেন আরও অনেক কর্মসূচির আবর্তন। তাই বুলেট ট্রেন প্রকল্পটির যৌক্তিকতা নিয়েই যদি প্রশ্ন উঠতে শুরু করে নানা মহল থেকে, তা হলে অন্যান্য ক্ষেত্রের নানা অর্জন মাঠে মারা যাওয়ার উপক্রম হয়। যে দেশে আধুনিক জীবনযাত্রার স্বাভাবিক তথা বুনিয়াদি চাহিদাগুলো সর্বাংশে পূরণ করা সম্ভব হয়নি এখনও, সেই ভারতে বিপুল-বিপুল ব্যয়ে বুলেট ট্রেন ছোটানোর চেষ্টা কেন? প্রশ্ন তুলছে কংগ্রেস। বিরোধী দল বলেই কংগ্রেস বিরোধিতা করছে, ধরে নেওয়া যাক তর্কের খাতিরে। শিবসেনার বিরোধিতার ব্যাখ্যা তা হলে কী হবে? বিজেপির সবচেয়ে পুরনো শরিক তারা। বুলেট ট্রেন প্রকল্পকে ‘প্রধানমন্ত্রীর দামি স্বপ্ন’ বলে কটাক্ষ করেছে শিবসেনা। এই স্বপ্ন পূরণের জন্য জনসাধারণের টাকা ‘লুঠ’ হবে বলেও লেখা হয়েছে শিবসেনার মুখপত্রে। শরিক দলের তরফ থেকে এমন তীব্র শ্লেষ কিন্তু মোদীর অস্বস্তি বাড়াতে বাধ্য।
শুধু রাজনৈতিক শিবিরে নয়, সাধারণ্যেও কটাক্ষ, ব্যঙ্গ, শ্লেষের আভাস রয়েছে কিছু। বুলেট ট্রেন ছোটাতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী, শহরতলির ট্রেনের বাদুড়ঝোলা-হাঁসফাঁস অবস্থা জানেন তো? প্রশ্ন কোনও নিত্যযাত্রীর। সাধারণ ট্রেনই রোজ বেলাইন হয়, বুলেট ট্রেনের সাধ? প্রশ্ন অন্য কারও। প্রশ্নগুলো অযৌক্তিক নয় মোটেই। অতএব প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়ার দায় রাষ্ট্রের রয়েছে।
বুলেট ট্রেন প্রকল্পও কিন্তু অযৌক্তিক নয় তা বলে। ভারতের বুনিয়াদি পরিকাঠামোর প্রতুলতা নিয়ে কতগুলো প্রশ্ন উঠেছে ঠিকই। বুলেট ট্রেন প্রকল্পের শিলান্যাসকে ঘিরেই প্রশ্নগুলো উঠেছে, তাও ঠিক। তবু বুলেট ট্রেনও জরুরি এ দেশে। আধুনিক বিশ্বের মাপকাঠিতে ভারতের সাফল্য ও অগ্রগতির লেখ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুঙ্গ স্পর্শ করেছে ইতিমধ্যেই। অগ্রগতির সেই ধারা বহাল রাখতেই হবে আমাদের। নতুন নতুন শিখর জয়ের লক্ষ্যে এগোতে হবে। তার জন্য বুলেট ট্রেনের মতো প্রকল্প হাতে নেওয়াও জরুরি। কিন্তু সর্বোদয়ের ধারণাটাও মাথায় রাখতে হবে। আধুনিক জীবনযাত্রা বলতে যা বুঝি, তার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক বন্দোবস্তটা প্রত্যেক নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রকে করতেই হবে। সেই লক্ষ্যে কাজটা আরও দৃষ্টিগোচর ভাবে ইতিমধ্যেই যদি শুরু করে দিতে পারতেন নরেন্দ্র মোদীরা, তা হলে স্বপ্নের বুলেট ট্রেন প্রকল্পকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আর কারও সামনে থাকত না সম্ভবত।
আগামী পাঁচ বছরে শেষ হওয়ার কথা বুলেট ট্রেন প্রকল্পের কাজ। ২০২২ সালে স্বাধীনতা দিবসে ভারতীয় ভূখণ্ডে বুলেট ট্রেনের দুরন্ত দৌড় দেখতে চান, দেখাতে চান নরেন্দ্র মোদী। যে রন্ধ্রপথ দিয়ে আজ হানা দিল অঙ্কুশ, শিলান্যাসের আগে না হোক, বুলেট ট্রেনের দৌড় শুরুর আগে অন্তত সেই রন্ধ্রগুলো নরেন্দ্র মোদীরা অনেকটাই বুজিয়ে ফেলতে পারবেন, এই আশা রাখছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy