বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বৈশিষ্ট্য, তিনি রাজনীতির ঔচিত্য-অনৌচিত্যকে এক চুলও পাত্তা দেন না, তাঁহার প্রধান সম্বল— রাজনীতির কৌশল। কৌশল বিষয়টি তিনি অত্যন্ত ভাল বোঝেন, এবং অধিকাংশ সময়ই সফল ভাবে ব্যবহার করিতে পারেন। গত সপ্তাহান্তে তেমনই একটি প্রচেষ্টা দেখা গেল, যখন প্রধানমন্ত্রী মোদী গোরক্ষকদের হামলার বিষয়টিকে সুচারু কৌশলে ‘রাজ্যের দায়িত্ব’ বলিয়া নিজের হাত ধুইয়া ফেলিতে চাহিলেন। তাঁহার বক্তব্য, গোরক্ষার নামে হামলা তো আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রশ্ন। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা তো রাজ্যের কাজ! কথাটি অর্থপূর্ণ, সন্দেহ নাই, যদিও অতি আংশিক ভাবে অর্থপূর্ণ। গোটা দেশ জুড়ে গোরক্ষকদের যে তাণ্ডব, এক দিক দিয়া দেখিলে তাহা খুচরা স্থানীয় সমস্যা। রাজ্য প্রশাসন কড়া ভাবে দুষ্কৃতীদের দমন করিলে তাণ্ডবকারীরা ক্রমে ভয় পাইবে, পিছু হটিবে। তবে কিনা, বিষয়টি এতই সরল হইলে আরও প্রশ্ন উঠিবে। রাজ্য প্রশাসনগুলি গোরক্ষকদের এই ভাবে দমন করিতেছে না কেন? প্রধানত বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতেই এই তাণ্ডব দেখা যাইতেছে কেন? তৃতীয়ত, কিছু ধরপাকড় সত্ত্বেও গোরক্ষকরা পুলিশ-প্রশাসনকে ভয় পাইতেছে না কেন? এই সব প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী কী বলিতেন জানা নাই। কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁহার নানা বক্তৃতার মধ্য দিয়া যে আশঙ্কাটি প্রবল হইয়া উঠিয়াছে তাহা হইল— এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং তিনি। সুতরাং সংসদে সর্বদলীয় বৈঠকের প্রাক্কালে তড়িঘড়ি রাজ্যের ঘাড়ে দায়িত্ব ঠেলিয়া দিলে তাহা ভাল ‘কৌশল’ হইতে পারে, সেই কৌশলে এক ভাবে বিরোধীদের চুপ করানোও সম্ভব হইতে পারে, কিন্তু কোনও মতেই তাহাকে ‘উচিত’ কাজ বলা যায় না।
যত বার প্রধানমন্ত্রীর মুখে গোরক্ষার মাহাত্ম্য উচ্চারিত, তাহার পাশাপাশি কয় বার গোরক্ষকদের গণপিটুনির নিন্দা শোনা গিয়াছে? এই সুচিন্তিত বৈষম্য কি কিছুই বলে না? এতগুলি রাজ্যে একই দুষ্কার্য, তবু তাহা কেবল রাজ্য সরকারেরই দায়? কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিপ্রসূত পদক্ষেপের ফলে রাজ্যে রাজ্যে নির্যাতনের এই মাত্রাবৃদ্ধিতে কেন্দ্রের কোনওই দায় নাই? যিনি নীতি বানাইবেন, নীতির দায়টি তাঁহাকেও লইতে হইবে বইকি। নরেন্দ্র মোদীর শাসনের আগে তো গোরক্ষক বাহিনীর এমন প্রতাপ ছিল না, হঠাৎ এখনই তাহা বাড়িল কেন, কাহার জন্য? উত্তর সহজ। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে গণপিটুনি অব্যাহত থাকিতে পারে বিজেপি-আরএসএস-এর অবস্থানের কারণেই। গোরক্ষকরাও বোধ করি তাহা বিলক্ষণ জানে। জানে যে, সবার উপর মোদীজি সত্য। গরুর নামে মানুষ মারিবার ইহাই প্রকৃষ্ট সময়!
গোরক্ষকদের উপদ্রব লইয়া মাঝে মাঝে একটি-দুইটি নিন্দাবাক্য মোদীর মুখে বাহির হয় নাই, তাহা নহে। গত সপ্তাহের ভাষণও তাহার নজির। কিন্তু লক্ষণীয়, ভয়ংকর অন্যায় যখন ঘটে, তাহা ২০০২ সালের গুজরাতেই ঘটুক অথবা ২০১৫ সালের দাদরিতে— তখন প্রধানমন্ত্রীর কোনও প্রতিক্রিয়া শোনা যায় না, স্বভাবত বাক্বহুল নরেন্দ্র মোদী তখন বহু সমালোচনাতেও নীরব নিস্পন্দ থাকেন। তাহার অনেক দিন পরে তিনি আপন হিসাবনিকাশ অনুসারে একটি মাহেন্দ্রক্ষণ বাছিয়া বাণী দেন: ‘যাহা ঘটিয়াছে, তাহা ঘোর অন্যায়।’ মর্মান্তিক ঘটনা যাঁহার মর্মে আঘাত করে, তিনি এত হিসাব কষিবেন কেন, সেই সংশয় স্বভাবতই থাকিয়া যায়। দুর্ভাগ্য, ভারতীয় সমাজের একটি বিশাল অংশ তাঁহার হিন্দুত্বপ্রচার মহিমায় এমনই মোহিত যে এই সব তুচ্ছ নৈতিকতার প্রশ্ন লইয়া মাথা ঘামাইতে তাঁহারা রাজি নন। আর বিরোধী নেতৃবৃন্দ? নখদন্তবিহীন সেই নেতারা নিজেদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ লইয়া অতি বিভোর। মাঝখান হইতে চূড়ান্ত নিকৃষ্ট দুর্বৃত্ত-প্রশ্রয়ী রাজনীতি বিজয়ীর অট্টহাস্য হাসে, আরও এক বার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy