Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

মায়াবতীর দলিত-বন্ধু ভাবমূর্তিতে ভাঙন ধরেছে

নিজের পথনির্দেশিকা কী হবে তা নিয়ে নাকাল হচ্ছেন মায়াবতী। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালকাঁসিরাম মনুবাদী হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেও তিনি ঠিক ততটা বৌদ্ধ বা মার্কসবাদী বা নাস্তিক হননি যতটা বি আর অম্বেডকর হয়েছিলেন। কাঁসিরামের মৃত্যুর পর মায়াবতী তাঁর হাতিকে নিয়ে গোটা দেশে এগোতে চেয়েছিলেন। কোনও এক সময়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখেছিলেন।

কাঁসিরামের সঙ্গে সাংবাদিক বৈঠকে মায়াবতী।—ফাইল চিত্র।

কাঁসিরামের সঙ্গে সাংবাদিক বৈঠকে মায়াবতী।—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

কাঁসিরামকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। বেশ কয়েক বার মায়াবতীর সঙ্গে কাঁসিরাম যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনও করেছেন, কখনও লখনউ, কখনও দিল্লিতে। লখনউতে কাঁসিরামের সঙ্গে বেশ কয়েক বার দেখা করেছিলাম একান্তে। বহুজন সমাজ পার্টির জন্মদাতা কাঁসিরাম দলিত সমাজকে সুসংহত করার জন্য নিজের মতো করে একটা মতাদর্শ খাড়া করেছিলেন। প্রাক্তন এই আমলার মধ্যে কিন্তু ভারতীয় রাজনীতির এক বৃহৎ প্রেক্ষাপট ছিল। মায়াবতীকে তিনি নিজের হাতে গড়েছিলেন। অম্বেডকরের দর্শন থেকেও তিনি নিজের মতো করে উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। চোখ বুজে অম্বেডকরের সবটাই গ্রহণ করেননি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি বহুজন সমাজ পার্টির দর্শনকে ‘আপডেট’ করেন।

কাঁসিরাম মনুবাদী হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেও তিনি ঠিক ততটা বৌদ্ধ বা মার্কসবাদী বা নাস্তিক হননি যতটা বি আর অম্বেডকর হয়েছিলেন। কাঁসিরামের মৃত্যুর পর মায়াবতী তাঁর হাতিকে নিয়ে গোটা দেশে এগোতে চেয়েছিলেন। কোনও এক সময়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখেছিলেন। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে বিপুল ভোটে মায়াবতী জিতে লখনউ তখত দখল করলেও পরবর্তী কালে তাঁর জয়ের মহিমা ধরে রাখতে পারেননি। ফের সমাজবাদী পার্টি ক্ষমতায় এসেছ‌ে। বিগত বিধানসভা নির্বাচনেও মায়াবতী সফল হতে পারেননি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও তাঁর ভরাডুবি হয়। যেমন, ২০১৭ সালের নির্বাচনেও আসন সংখ্যায় বিরাট ধাক্কা হয়েছে। তবে মায়াবতীর ভোটব্যাঙ্ক কিন্তু শূন্য হয়ে যায়নি। আসন হারালেও ভোটব্যাঙ্ক অটুট আছে অনেকটাই। মায়াবতী উত্তরপ্রদেশে চার বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, অথচ এখন মায়াবতীর বিধায়কের সংখ্যা মাত্র ১৯। লখনউয়ের বিধান পরিষদে প্রবেশ করার মতো ক্ষমতা নেই তাঁর।

১৯৯৩ সালে বহুজন সমাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কাঁসিরাম সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জোট করে ক্ষমতাসীন হন। তখন সমাজবাদী পার্টি ছিল বড় পার্টি। সে জোট বেশি দিন চলেনি। মাঝপথে রণে ভঙ্গ দেয় বহুজন সমাজ পার্টি। ১৯৯৫ সালে মায়াবতী মুখ্যমন্ত্রী হন। মায়াবতী এ দেশে প্রথম মহিলা তফসিলি মুখ্যমন্ত্রী হন। ১৯৯৭ এবং ২০০২ সালে মায়াবতী আবার মুখ্যমন্ত্রী হন। ২০০২ সালে মুখ্যমন্ত্রী হলেও ২০০৩ সালের ২৬ অগস্ট মায়াবতী ক্ষমতাচ্যুত হন। কারণ, বিজেপি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। তখন মায়াবতী এবং বিজেপি জোটের সরকার ছিল। এর পর ২০০৭ সালে মায়াবতী আরও বিপুল ভোটে জিতে একক ভাবে ক্ষমতায় আসেন। কাজেই মায়াবতী বিজেপির সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে নিজের ভোটব্যাঙ্ক আরও বাড়িয়েছিলেন। ২০০৭ সালে বিএসপি ক্ষমতায় এসেছিল ৪০৩টি আসনের মধ্যে ২০৬টি আসন আদায় করে। ভোটে জেতার জন্য মায়াবতী এক অভিনব সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-ও করেন। তিনি নিজের দলিত ভোটকে করায়াত্ত করে নির্বাচনে হিন্দু ভোটেরও দখল নেন। তিনি প্রচুর ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের প্রার্থী দিয়ে উচ্চবর্ণের ভোটব্যাঙ্কের মৌরসিপাট্টা ভেঙে দিয়েছিলেন। ‘সর্বজন সুখায়ে, সর্বজন হিতায়ে’ স্লোগান দিয়েছিলেন তিনি। এ এক নতুন বহুজন সমাজ পার্টি।

মায়াবতীর প্রতি জমসমর্থন কি এখনও এতটাই রয়েছে?—ফাইল চিত্র।

২০১২ থেকে ২০১৪, সেখান থেকে ২০১৭— মায়াবতীর ভোটব্যাঙ্কেও ভাঙন ধরেছে। মায়াবতীর মনে হয় উচ্চবর্ণের ভোট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য দলিত ভোট বিগড়ে গেছে। অ-জাঠ ভোটব্যাঙ্ক অন্য দলে, এমনকী, কংগ্রেসেও গেছে। আবার মুসলমান ভোটকেও এ বার তিনি কাছে টানার চেষ্টা করেন। সব মিলিয়ে নিজের পথনির্দেশিকা কী হবে তা নিয়ে বেশ হিমশিম খেতে শুরু করেন মায়াবতী।

আজ এত বছর পর রাজ্যসভায় মায়াবতী দলিত ইস্যুতে ইস্তফা দিয়ে আবার উত্তরপ্রদেশে নিজের ভোটব্যাঙ্ককে সংযুক্ত করার চেষ্টা করছেন। শোনা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলে ফুলপুর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে প্রার্থীও হতে পারেন। কারণ, রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী কেশবপ্রসাদ মৌর্য এই লোকসভা কেন্দ্রের সদস্য ছিলেন। ফুলপুর আসনটি নেহরু থেকে লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও গুলজারিলাল নন্দ পর্যন্ত অনেক ব্যক্তিত্বের স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত। এমনও হতে পারে, সমাজবাদী পার্টিও মায়াবতীকে সমর্থন করতে পারে। হতে পারে, বিরোধী দলের সম্মিলিত প্রার্থীও হতে পারেন তিনি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস-মায়াবতী-অখিলেশের জোটের সম্ভাবনাও সে ক্ষেত্রে বাড়বে। মায়াবতী এবং অখিলেশ, দু’জনেই বুঝতে পারছেন, বিজেপির মোকাবিলা করতে গেলে এখনই জোট বাঁধা বিশেষ প্রয়োজন।

তবে মায়াবতীর রাজনীতিকে যে ব্যর্থতার মোকাবিলা করতে হচ্ছে তার প্রধান কারণ হল, মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির জন্মলগ্ন থেকে দলিত স্বার্থরক্ষার কথা বললেও সেটি নিছকই ‘প্রতীকী’ থেকে গেছে। দেশের কথা ছেড়ে দিন, উত্তরপ্রদেশেই সত্যি সত্যি দলিত স্বার্থ কতটা রক্ষিত হয়েছে? প্রথমত, দলিত কোটা ঘোষণা হলেও দলিত জনসমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কতটা হয়েছে? দ্বিতীয়ত, আজও দলিত হত্যা, দলিত সমাজের উপর নিপীড়ণ হচ্ছে কেন? তৃতীয়ত, বিজেপি, কংগ্রেস এবং অন্য দলগুলিও দলিত ভোট করায়াত্ত করার জন্য সক্রিয়। দলিত নেত্রীর ‘আইকন’ মায়াবতীর ব্র্যান্ড ইকুইটিতে কি তবে ভাঙন ধরেছে? তা না হলে চন্দ্রশেখরের মতো আর এক দলিত নবীন নেতা জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন কী ভাবে? সম্প্রতি দিল্লির যন্তর মন্তরে যে ভাবে চন্দ্রশেখর ধর্না ও সভা করে দেশের নজর কেড়েছেন তাতে উদ্বেগ বাড়ছে মায়াবতীর। যেমন জেএনইউ-এর কানহাইয়া নামক ছাত্রনেতার জনপ্রিয়তা কি মায়াবতীর জন্য অশনিসঙ্কেত?

মায়াবতী তাই এখন বুঝতে চাইছেন, জোট রাজনীতি অবশ্যম্ভাবী কিন্তু তাতে আখেরে তাঁর দলিত জনসমর্থন আরও বেশি অবক্ষয়ের শিকার হবে না তো?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE