Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Prisoner

বিচার নেই, কারাগার আছে

দেশে মোট বন্দির ৪.৬৬ লক্ষ লোকের প্রায় ৭০ শতাংশই (৩.৩ লক্ষ) বিনা বিচারে আটক। তাঁদের ধরে রাখা কেবল সন্দেহের বশে।

প্রতীকী চিত্র

প্রতীকী চিত্র

পিয়ালী পাল
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২০ ০৩:০৪
Share: Save:

কে  জানে কোথা থেকে কী হল? রাতে ঘরে ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ পুলিশ। আমাকে বাঁধল পিছমোড়া করে। কেন বাঁধল, কী বৃত্তান্ত, কিচ্ছু বুঝলাম না। নিয়ে গেল থানায়, তার পর জেলে। জেল থেকে মাঝে মাঝে কোর্টে নিয়ে যেত। তার পর কী ভাবল কে জানে, দু’বছর পর ছেড়ে দিল। আবার হয়তো মন হবে, তখন ধরে নিয়ে যাবে,” বলছিলেন শাল্কু মান্ডি। বাড়ি বাঁকুড়ার জঙ্গলে ঘেরা এক গ্রামে। ২০১৪’তে একটা গ্রামসমীক্ষার কাজে গিয়ে তাঁর দোরে বসে শুনছিলাম শাল্কুর কথা। শাল্কু নিরক্ষর, শাল্কু খেতমজুর। শাল্কুর বৌ উকিল দিতে পারেননি। শাল্কুর আত্মীয়স্বজন সবাই গরিব, নিরক্ষর, আর পার্টি-পঞ্চায়েত-থানা-বিডিও কোথাও তাঁদের কেউ নেই। তাই শাল্কুদের ঘরে বা জেলে থাকতে হয় পুলিশ বা এর-তার মর্জিতে। দোষ করেছেন কি না তা প্রমাণ হওয়ার আগেই তাঁরা দু’-পাঁচ বছর বা তারও বেশি জেল খেটে দিচ্ছেন। তার পর যত দিনে বেকসুর খালাস হচ্ছেন, তত দিনে তাঁদের জীবনের সবচেয়ে ফলবান কয়েকটা বছর স্রেফ লুট হয়ে যাচ্ছে।

কী ভাবে? প্রথমত, দেশে মোট বন্দির ৪.৬৬ লক্ষ লোকের প্রায় ৭০ শতাংশই (৩.৩ লক্ষ) বিনা বিচারে আটক। তাঁদের ধরে রাখা কেবল সন্দেহের বশে। হয়তো কারও অপরাধ প্রমাণ হবে, সেটাও অনেকের ক্ষেত্রে হতে পারে কেবলমাত্র আইনি মদত না পাওয়ার জন্য। এই বন্দিদশার নির্দিষ্ট কোনও সময়সীমা নেই। কেসগুলোর ফাইলে ধুলোর মোটা পরত। নাগরিকদের সুরক্ষায় আইন, কিন্তু এই ‘সন্দেহভাজন’ লোকেদের যেন নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা নেই! তাঁরা জেলে পচুন, কারও কিছু এসে যায় না।

কেন এমন হয়, তার জটিল তত্ত্বকথা থাকুক। কিন্তু একটা জিনিস বোধ হয় চাইলেই সাদা চোখে দেখতে পাওয়া যায়। এই ‘সন্দেহভাজন’দের বেশির ভাগই (৭০ শতাংশ) শাল্কুর মতোই শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া— শতকরা ২৮ জনের অক্ষর পরিচয়ই ঘটেনি, শতকরা ৪২ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিকের নীচে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো (এনসিআরবি) বা অন্যান্য সূত্র থেকে বন্দিদের আর্থিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছু জানা যায় না, কিন্তু দেশে শিক্ষা ও দারিদ্রের সম্পর্ক বিষয়ে ওয়াকিবহাল যে কোনও লোকই এটা বুঝতে পারবেন যে, বিনা বিচারে আটক ৩.৩ লক্ষ মানুষই দরিদ্র পরিবারের থেকে আগত।

সম্পর্কটা শুধু দারিদ্র ও শিক্ষাগত বঞ্চনার নয়, আরও অনেক কিছুর। এখানে আছে জাতি, নৃগোষ্ঠী, এবং ধর্ম। এনসিআরবি-র ২০১৯ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, ভারতের বিচারাধীন বন্দিদের মধ্যে যথাক্রমে ২১ শতাংশ দলিত, ১১ শতাংশ আদিবাসী, ১৯ শতাংশ মুসলমান। অন্য ভাবে দেখলে, যেখানে দেশে প্রতি লক্ষ জনসংখ্যা পিছু বিনা বিচারে আটক বন্দির সংখ্যা ২৮, সেখানে দলিত, আদিবাসী ও মুসলমানদের মধ্যে সংখ্যাগুলো হল যথাক্রমে ৪২, ৪১ এবং ৪৫। এর মানে কি এই যে, দলিত, আদিবাসী ও মুসলমানরা জন্মগত অপরাধপ্রবণ? সমাজে অবশ্য এমন একটা ধারণাই চালু। যেমন, লোধাদের কথা উঠলেই সমাজের সুবিধাভোগীরা বলে ওঠেন, ‘ওরা তো চোর’। আজও আমরা কথায় কথায় শুনি ‘চুরিচামারি করে খাচ্ছে’। যেন চামাররা পেশাগত ভাবে চোর! আর মুসলমানদের তো কথাই নেই— নাম দেখে, পোশাক দেখে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া হয় ‘ওরা সন্ত্রাসবাদী’। খবরের কাগজের শিরোনাম হয়, এত জন জঙ্গি ধরা পড়েছে, কিন্তু একটু পড়লেই দেখা যায়, বিচারের আগেই বিচার করে দেওয়া হল। যাদের জঙ্গি ছাপ দিয়ে দেওয়া হল, তাদের তো আসলে ধরা হয়েছে সন্দেহের বশে, কারও সম্পর্কে মজবুত তথ্য থাকতেও পারে, কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে বই, প্রচারপত্র, চাঁদার রসিদ, চিনেপটকা, ইত্যাদি হয়ে ওঠে সাক্ষ্যপ্রমাণ। সন্দেহের ভিত্তিতে বন্দিদের সম্পর্কে যা কিছু ভেবে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, তাঁদের সঙ্গে যা খুশি আচরণ করারও ‘স্বাধীনতা’ পেয়ে যায় রাষ্ট্র। গাদাগাদি করে ভরে রাখা (গড়ে একশো জনের জায়গায় রাখা হয় একশো সতেরো জনকে), খাবার, চিকিৎসা, অন্যান্য সুযোগসুবিধা— নানা দিক দিয়ে তাঁরা যে ব্যবহার পান, তাকে মানবিক বলা খুবই কঠিন।

অপরাধ দমনের নামে হাজারে হাজারে লোককে জেলে ভরে রাখা কোন ন্যায়বিচার? বিনা বিচারে আটক বন্দিদের প্রায় ৮৯ শতাংশের বয়স পঞ্চাশের নীচে— এঁদের মধ্যে আবার ৫৫ শতাংশের বয়স তিরিশের কম। কেউ কি এঁদের জীবনের এই বছরগুলো ফেরত দেবে? এমনিতেই ক্ষমতাবানরা এই মানুষদের বিরুদ্ধে মস্ত এক অপরাধ করে চলেছেন— তাঁদের শিক্ষার, স্বাস্থ্যের, কাজের সুযোগগুলো না দিয়ে, মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার না দিয়ে। সেই অপরাধের বিচারের আশা এঁরা করেন না, কিন্তু অন্তত বিনা বিচারে জেলে পুরে রাখার অন্যায় থেকেও মুক্তি নেই?

অন্য বিষয়গুলি:

Prisoner Jail
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy