Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

প্রতিনিধি

মানব উন্নয়নের বিবিধ সূচকের অধিকাংশেই পশ্চিমবঙ্গের স্থান মধ্যস্থলে বা অন্তিমে। বহু বিষয়ে ন্যূনতম প্রয়োজন মেটে নাই। অতএব আত্মতুষ্টির কোনও অবকাশ সরকারের নাই।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৯ ০০:১১
Share: Save:

গুরুর ভিক্ষার ঝুলিতে শিবাজি রাজ্যের স্বত্ব সমর্পণ করিলে গুরু রামদাস নির্দেশ দিয়াছিলেন, অতঃপর ‘ভিক্ষুকের প্রতিনিধি’ হইয়া শিবাজিকে রাজধর্ম পালন করিতে হইবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের ‘প্রতিনিধি’ কবিতাটি পড়েন নাই। শাসক যে সেবক, প্রাচীন এই আদর্শ যে আধুনিক রাষ্ট্রেও পালনীয়, কথাটি তাঁহার স্মরণে নাই। ফলে, তিনি বলিয়াছেন, রাজ্যবাসীর জন্য তিনি ‘একটু বেশিই’ কাজ করিয়া ফেলিয়াছেন। দৃশ্যত, তিনি রাজধর্মের মূল মন্ত্রটি ভুলিয়াছেন। তাহা বিনম্র সেবার মন্ত্র। নেতারা নির্বাচনী প্রচারে ‘জনগণের সেবা’ করিবার অঙ্গীকার করিয়া থাকেন বটে, কিন্তু নির্বাচিত হইলে রাষ্ট্রক্ষমতার মাদক তাঁহাদের মোহগ্রস্ত করিয়া ফেলে। বিনম্র সেবকের ঘাড়ে চাপে নবাব বা লাটসাহেবের ভূত। তখন দেশের সম্পদকে নিজের সম্পদ, এবং দেশবাসীকে অধীন প্রজা বলিয়া ভুল হয়। নাগরিক অধিকারের সুরক্ষাকে ‘অনুগ্রহ’ এবং সরকারি সহায়তাকে ‘দান’ মনে হইতে থাকে। মুখ্যমন্ত্রী কি ভুলিয়াছেন, রাজ্যবাসীর একটি বড় অংশ আজও দরিদ্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য হইতে বঞ্চিত? শহর ও গ্রামে উন্নততর জীবনযাত্রার বহু প্রয়োজন মেটে নাই। সরকারের কাজ সকল রাজ্যবাসীর প্রয়োজন মিটাইয়াছে, সরকারি দাক্ষিণ্য নাগরিকের চাহিদা পূর্ণ করিয়া ‘অধিক’ হইয়াছে, ইহা এক অসম্ভব দাবি।

হয়তো সরকারের কর্তব্য বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ধারণাটির পরিধি খুব বড় নহে। দুই টাকা কিলোগ্রাম দরে চাল, সরকারি প্রকল্পের আবাস, হাসপাতাল নির্মাণ, স্কুলপড়ুয়াদের সাইকেল প্রভৃতি অনুদান, এইগুলি রাজ্যবাসীকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য ‘যথেষ্ট’, মমতা হয়তো এমন ভাবিয়াছিলেন। সম্ভবত সেই কারণেই তিনি সাংবাদিক বৈঠকে বলিয়াছেন, মানুষের জন্য তাঁহার কাজ সম্পূর্ণ হইয়াছে, কারণ এখন মৃত্যুর পরেও টাকা পাইতেছেন রাজ্যবাসী। পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যের মৃত্যুর পরে অনুদান বাস্তবিকই দরিদ্র পরিবারে প্রয়োজন। নানাবিধ সরকারি সহায়তা জুগাইবার প্রতিদান মমতা ইতিপূর্বে বিভিন্ন নির্বাচনে পাইয়াছেন। কিন্তু সরকারের কাজ সম্পূর্ণ হইল কিসে? মানব উন্নয়নের বিবিধ সূচকের অধিকাংশেই পশ্চিমবঙ্গের স্থান মধ্যস্থলে বা অন্তিমে। বহু বিষয়ে ন্যূনতম প্রয়োজন মেটে নাই। অতএব আত্মতুষ্টির কোনও অবকাশ সরকারের নাই। বরং ‘অনেক দিয়াছি’ কথাটির মধ্যে যে ঔদ্ধত্য রহিয়াছে, তাহা রাজ্যবাসীকে আঘাত করিতে বাধ্য। নাগরিক কেবলই অবুঝ শিশুর ন্যায় আবদার করিতেছে, সরকার তাহা মিটাইতেছে— এই বিকৃত ছবি গণতন্ত্রের নহে।

হয়তো মুখ্যমন্ত্রীর অভিমান হইয়াছে। ‘বেশি’ কাজ করিয়া তৃণমূল কম আসন পাইয়াছে নির্বাচনে, তাহাতে আহত মমতা। তাঁহার সিদ্ধান্ত, অতঃপর তিনি দলের কাজ করিবেন বেশি। শাসকের চিত্ত দুর্বল হইলে এবং সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত হইলে দেশবাসী বিপন্ন হয়, এই কারণেই হয়তো পুরাণ-ইতিহাসে শাসকের প্রতি এত উপদেশ বর্ষিত হইয়াছে। মহাভারতের শান্তিপর্বে ভীষ্ম বলিতেছেন, হস্তির পদচিহ্ন যেমন অপর সকল প্রাণীর পদচিহ্নকে লোপ করিয়া দেয়, তেমনই রাজধর্ম সকল ধর্মকে অবলুপ্ত করে। যত দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকিবেন, তাঁহার দলের কাজ কখনওই শাসকের কর্তব্যকে ছাড়াইয়া যাইতে পারে না। তিনি জনগণের প্রতিনিধি, ইহাই তাঁহার পরিচয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee Governance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE