কাটমানি ফেরতের জের না কাটতেই এ বার ‘দিদিকে বলো’। জনগণের সামনে আরও একটি দরজা খুলে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাদের হাতে ‘অস্ত্র’ তুলে দিলেন বললেও হয়তো ভুল হবে না। শাসক দলের জামা গায়ে ওঠার ছ’আট বছরের মধ্যেই তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রী-জনপ্রতিনিধিদের একটি অংশ কী ভাবে সাধারণ মানুষের থেকে দূরে সরে গিয়েছেন, নির্বাচনী ধাক্কার পরে তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা। তাই জনবিচ্ছিন্নতার সেই গহ্বর ভরাতে একের পর এক পদক্ষেপ করতে হচ্ছে তাঁকে।
শুধু তা-ই নয়। শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মতো পুরনো বিশ্বস্তদের সঙ্গে ছিন্ন হয়ে যাওয়া সম্পর্কের সুতো নতুন করে বাঁধার চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। বলা যেতেই পারে, তৃণমূলের এ এক নব অভিষেক! ‘সংশোধনবাদী’ উদ্যোগ। লোকে বলছে, মমতা নিজেকে দ্রুত বদলে ফেলছেন। বাস্তবতার নিরিখে তিনি অনেক বেশি সহিষ্ণু, পদক্ষেপে অনেক বেশি সংযত এবং অকপট।
সকলেই জানেন, লোকসভা ভোটের ফল পর্যালোচনা করতে বসে বিভিন্ন জেলায় দলের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসাবে মমতাকে শুনতে হয়েছে তাঁর দলের বহু নেতা ও জনপ্রতিনিধির প্রশ্নবোধক জীবনযাপন এবং মানুষের থেকে দূরে সরে যাওয়ার অভিযোগ। ওই নেতাদের ‘দালালি’ বা কাটমানি না দিলে জনগণ তাদের প্রাপ্য পায় না, সে কথাও শুনেছেন তৃণমূল নেত্রী।
জনমনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বাষ্প বার করে দিয়ে শাসক দল ও সরকারের ‘স্বচ্ছ’ ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তাই প্রথম দাওয়াই এল কাটমানি ফেরানো। তার পরেই জনপ্রতিনিধিদের গ্রামে, পাড়ায় গিয়ে জনগণের পাশে বসে কথা শোনা, এবং সর্বশেষ এসেছে ‘দিদিকে বলো’।
উদ্দেশ্য যতই ‘মহৎ’ হোক, এর কোনওটিই কিন্তু খুব মসৃণ হচ্ছে না। কাটমানি ফেরানো নিয়ে রাজ্য জুড়ে কার্যত আইনশৃঙ্খলার সঙ্কট তৈরি হয়েছিল। নেতাদের গ্রাম সফরের ক্ষেত্রেও ছবি উজ্জ্বল নয়। বরং অনেক মন্ত্রীই তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়ছেন। গ্রামে রাত কাটানোর বদলে তাঁদের প্রায় ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা! এটা তাঁদের কৃতকর্মের ফল! এতে আরও প্রমাণ হয়, মাত্র আট বছরে নিচুতলায় মানুষের মনে শাসকদের সম্পর্কে কতটা বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে।
ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেল-এর মাধ্যমে অভিযোগ জানানোর সুযোগ দিয়ে মমতা যে দিন ‘দিদিকে বলো’ ব্যবস্থাটি চালু করলেন, তার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই দাখিল হল লক্ষ অভিযোগ। অর্থাৎ, সাধারণ লোকের এত অভাব-অনুযোগ জানানোর ছিল! এর মধ্যে কিছু অবশ্যই অযৌক্তিক, অসার, অন্যায্য। কিন্তু যদি অর্ধেকও বিবেচনার মতো হয়ে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে নিরসনের প্রয়োজন নেহাত ফেলনা নয়। আসলে মানুষ যা জানাচ্ছে, সেটা সমসময়ের বাস্তব পরিস্থিতি। বলা চলে, ভোটের আয়না!
অনেকের ধারণা, রাজ্যে আগামী বিধানসভা ভোটের আগে ধাক্কা খাওয়া ইমারত মেরামতের জন্য এই সব পরামর্শ মমতাকে দিয়েছেন ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোর। আপাতদৃষ্টিতে লক্ষ্য, ক্ষোভের জায়গাগুলি চিহ্নিত করা, কিছু কিছু পদক্ষেপ করে প্রতিবিধানের ‘সদিচ্ছা’ বোঝানো এবং সর্বোপরি ‘মমতায় আস্থা’ অটুট রাখার বার্তা দেওয়া।
তবে নেপথ্যে আর একটি কারণও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। সেটি হল, প্রার্থী বাছাই। নিজের দলের নানা বিচ্যুতির কথা খোলাখুলি বলে মমতা ইতিমধ্যেই বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি এ সব ব্যাপারে কাউকে রেয়াত করবেন না। কারণ ‘স্বচ্ছতা’ এ বার তাঁর বড় পরীক্ষা। তাই এখন জনপ্রতিনিধিদের সরেজমিন মাঠে নামিয়ে তিনি সরাসরি দেখে নিতে চাইছেন, সাধারণ লোকের চোখে কার অবস্থান কী রকম। কাদের সম্পর্কে মানুষ কী বলছে। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের সময় সেই সব মূল্যায়নকে প্রাথমিক ভিত্তি করা হবে না, তা বলা যায় না।
বস্তুত বিধানসভা ভোটে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একগুচ্ছ নতুন মুখের পক্ষপাতী প্রশান্ত কিশোরও। ভোট-কুশলীরা অনেকেই মনে করেন, কোনও দলের ‘ভাবমূর্তি’ ফেরাতে প্রার্থী তালিকা বড় ভূমিকা নিতে পারে। বিশেষ করে, ক্ষমতাসীন দলের বেলায় ভোটারদের ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী’ মানসিকতা মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রার্থী তালিকায় বড় মাপের রদবদল অনেক সময় কার্যকর হয়। এটা ক্ষমতায় থাকাকালীন সিপিএম-ও করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তৃণমূল তা করবে না, কে বলতে পারে! মমতা হয়তো তারই আঁচ পেতে চাইছেন। যদিও এখনই এ সব বলার সময় আসেনি। রাজনীতির গতি কখন কী ভাবে মোড় নেয়, তার উপর নির্ভর করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
আবার এরই পাশাপাশি বোঝা যাচ্ছে, মমতা তাঁর পুরনো ‘বিশ্বস্ত’দের দূরে রাখাটাও সমীচীন বলে মনে করছেন না। ‘ওল্ড ইজ় গোল্ড’ কথাটি তিনি প্রায়শই বলেন। লোকসভা ভোটের পরে তাঁর এই উপলব্ধি আরও গভীর হয়েছে। দলের আদি পর্ব থেকে যাঁরা লড়াই-আন্দোলন করে এসেছেন, তাঁদের উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। যার একটি উল্লেখযোগ্য ফলিত প্রয়োগ, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের গোলপার্কের ফ্ল্যাটে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নৈশ-অভিযান।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, তৃণমূলে শোভনের সবচেয়ে বড় তকমা ছিল বিশ্বস্ততা। মমতার যে কোনও ইচ্ছা বা ভাবনার রূপায়ণ শোভনের কাছে ছিল প্রশ্নাতীত কর্তব্য। মমতাও মানতেন, যে কোনও প্রয়োজনে তাঁর স্নেহের ‘কানন’-এর উপর চোখ বুজে নির্ভর করা যায়। স্নেহের যাবতীয় প্রশ্রয়ও কানন-ভাইকে তিনি দিয়েছেন। এ হেন শোভন তেজ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র পাঠানোর পরে মমতার পক্ষে সেটা কতখানি মর্মান্তিক হয়, তা-ও হয়তো নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
এমনই এক আবেগের সুতোয় টান ধরে রয়েছে আজ আট-ন’মাস। গত নভেম্বরে প্রথমে রাজ্যের মন্ত্রিত্ব, তার পরে কলকাতার মেয়রের পদ ছেড়ে শোভন রাজনীতির প্রত্যক্ষ সংস্রব থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। তাঁর জীবনে হঠাৎ আসা ‘বিপদের বন্ধু’ বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করেই পরিস্থিতি দ্রুত এই দিকে গড়িয়েছে, তা ঠিক। কিন্তু আপাত ভাবে যা দেখা যায়, অনেক সময় তার অন্দরে আরও কিছু লুকানো থাকে। যেমন, কোনও ব্যক্তির শরীরে হয়তো মারণরোগ বাসা বেঁধেছে। মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু হঠাৎ পথ-দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হল। ফলে আসল রোগটি চাপা পড়ে গেল!
এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, শোভনের জেদি পদক্ষেপের পিছনে কি শুধুই বৈশাখী-ঝড়? না কি তৃণমূল ছাড়ার অন্য কোনও সুপ্ত কারণও তাঁর ছিল? বৈশাখী-পর্ব কি তাঁকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে? শোভন রাজনীতিতে নবাগত কিংবা অপরিচিত নন। তাই যুক্তি বলে, তিনি যদি সরাসরি কোনও বিকল্প রাজনৈতিক পথের কথা ভাবতেন, তা হলে এত দিনে কোনও অর্থবহ পদক্ষেপ করতেই পারতেন। তা তিনি করেননি। আজও কাগজ-কলমে তিনি তৃণমূলের বিধায়ক এবং কাউন্সিলর। সত্যি বলতে কী, তৃণমূল বা মমতা সম্পর্কে আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে শোভন কোনও বিরূপ মন্তব্য করেছেন বলেও জানা নেই। এটা তাৎপর্যপূর্ণ।
জনান্তিকে শোনা যায়, তাঁর নাকি ক্ষোভ জমছিল তৃণমূলে নব যুবশক্তির উত্থানের পর থেকে। উত্থান এবং ঔদ্ধত্য একাকার হয়ে গেলে সমস্যা বাড়ে। শোভন তৃণমূলে ‘ম্যাচ উইনার’ হিসাবে শুধু মমতাকেই মানতে চেয়েছেন। অন্য কোনও মুখের হোর্ডিং তিনি দেখতে চাননি, আজও হয়তো চান না।
তৃণমূলের সংসারের এই সমস্যা কী ভাবে মিটবে, সেটা তাদের ব্যাপার। তবে রাজনীতি, সময়, প্রয়োজনীয়তা সবই পরিবর্তনশীল। মমতার দিক থেকে বার্তাও অনেকটা স্পষ্ট।
‘সংশোধনবাদী’ তৃণমূলে এটা কিন্তু মোটেই কম কথা নয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy