Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
আপনার অভিমত

ইতিহাস ছুঁয়ে প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীতে মালদহ কলেজ

দুর্ভিক্ষ, মৃত্যুমিছিল আর স্বাধীনতার লড়াই। এর মধ্যেই নির্জনে জন্ম নিয়েছিল মালদহ কলেজ। ঐতিহাসিক যে কলেজ আজ ৭৫ বছরে। লিখছেন সৌরেন বন্দ্যোপাধ্যায়দুর্ভিক্ষ, মৃত্যুমিছিল আর স্বাধীনতার লড়াই। এর মধ্যেই নির্জনে জন্ম নিয়েছিল মালদহ কলেজ। ঐতিহাসিক যে কলেজ আজ ৭৫ বছরে। লিখছেন সৌরেন বন্দ্যোপাধ্যায়

স্মরণিকা: ১৯৪৪ সালে কিরণশঙ্কর মজুমদারের করা মালদহ কলেজের স্কেচ।

স্মরণিকা: ১৯৪৪ সালে কিরণশঙ্কর মজুমদারের করা মালদহ কলেজের স্কেচ।

শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৪৬
Share: Save:

আমরা তো তিমির বিনাশী হতে চাই’। অথচ, প্রতিদিনই সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে অনাহারে মৃত অসংখ্য মানুষ। তেরোশো সনের মধ্যবর্তী মালিক-মজুতদার মানুষ ছিল কি? না, তার জবাব সে ভাবে পাওয়া যায়নি। গ্রামের অসহায় মানুষ শহরের দিকে, নগরের দিকে পাড়ি জমাচ্ছিলেন। রংপুর, ময়মনসিংহ, বাকরগঞ্জ, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম— সর্বত্র দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর মিছিল।

১৯৪৩ সালের মে থেকে জুন মৃত্যুর হার ছিল দ্বিগুণ, জুলাইয়ে মৃত্যুর হার চার গুণ হয়ে যায়। যদিও ১৯৪১ সালের তুলনায় ১৯৪৩ সালে খাদ্যের উৎপাদন যথেষ্ট ছিল। শুধুমাত্র সরকারি বণ্টন ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণেই এত মৃত্যু অনাহারে। দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বলছে যে মালদহ, হুগলি, যশোর জেলায় মৃত্যুর হার অপেক্ষাকৃত কম ছিল। চার আনার চিনি দু’টাকা সের, এক আনার লবণ এক টাকা সের। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তখন বিপর্যস্ত।

ঠিক এমনই সময় ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সঙ্কটে বেতনহীন দুই শিক্ষক ছাত্রদের দুরবস্থা সহ্য করতে না পেরে কলেজের খাতাপত্র এবং ছাত্রদের নিয়ে তৎকালীন দাদনচকের আদিনা ফজলুল হক কলেজ থেকে মালদহ শহরে চলে আসছেন। অনাহারে মৃত্যুর মিছিলে কৃষকসভার প্রচেষ্টায় তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল। জমিদার ও জোতদারদের জমি নিজেদের দখলে রাখাটাই একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। রাজা-প্রজার সম্পর্কের বৈষম্য তখন যেন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছিল। নিজেদের দখলে রাখা ভূমি কী ভাবে অধিকারে রাখা যায়, তার জন্য জমিদার ও জোতদারেরা নানা কৌশলের সঙ্গে রাজনৈতিক ছত্রছায়া এবং সামাজিক নানা কাজে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তখনই যেন শোনা যেতে লাগল— ‘ভুখা মানুষ ধরো বই, ওটা হাতিয়ার’।

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে জাপানি বোমারু বিমান। ব্রিটিশ সরকারও বেশ ভয়ে আছে। কলকাতা ছেড়ে মানুষ তখন মফস্সল শহরে কিংবা গ্রামের বাড়িতে ভিড় বাড়াচ্ছেন। জাপানি সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণ চলছে চিনের অন্তত তিনটি শহর হুনান, হেনান, গুয়াংসির উপর। জাপানি সহযোগিতায় কোহিমায় সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবেশ করছে। ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে ইম্ফলে আজাদ হিন্দ বাহিনী অবস্থান করছে। আর ঠিক সেই সময়েই মালদহে উৎসাহের সঙ্গে কলেজ তৈরির তোড়জোড় চলছে। কৃষক-শ্রমিক প্রজাপার্টির নেতা ও তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের প্রিয়পাত্র ইদ্রিস আহম্মদ বি এলের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার মাধ্যম হয়ে ওঠা দাদনচক আদিনা ফজলুল হক কলেজ থেকে শিক্ষকেরা ছাত্র-সমেত মালদহে এসে পৃথক সত্তার মালদহ কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। শহরের মধ্যে জমি কী ভাবে পাওয়া যাবে, তার জন্য অনুসন্ধান চলছিল এবং সম্প্রদায় নির্বিশেষে আলোচনা সভায় তাঁরা মত প্রকাশ করেছিলেন।

সমকালীন গৌড়দূত পত্রিকা এবং কলেজের মিনিটস্ বুক থেকে কলেজের গড়ে ওঠার প্রথম পর্ব সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জানা যায়। অতুলকুমার পৌরবাজার নামে আশুতোষ চৌধুরীর (যিনি কলেজের গভর্নিং বডির সম্পাদক ছিলেন) পুরাতন জমিদার কুঠিতে শ’খানেক ছাত্রছাত্রী ছ’জন শিক্ষক নিয়ে ১৩৮ টাকা ভাড়ায় মালদহ কলেজ ইন্টারমিডিয়েট আর্টস ও কমার্স কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ইংরেজি, বাংলা, দর্শন, অর্থনীতি, ইতিহাস এবং সংস্কৃত বিভাগ শুরু হয়। ১৯৪৪ সালের ১ মে অনুমোদন দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯৪৪ সালের ২৩ জুলাই তৎকালীন মালদহের জেলাশাসক সৌমারেজ স্মিথ এই কলেজের উদ্বোধন করেন। পড়াশোনা শুরু করার পরই কলেজের ভবন প্রতিষ্ঠার জন্য যদুনন্দন চৌধুরী, আশুতোষ চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিত্বেরা ভূমিদান সংগ্রহ করেন এবং চাঁচলরাজ শরৎচন্দ্র রায় চৌধুরীর মতো দানশীল মানুষ এই মহৎ প্রচেষ্টায় ৩০ হাজার টাকা দান করেন।

মালদহ কলেজ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন অতি সাধারণ থেকে ধনী মানুষ সকলেই। অর্থসংগ্রহ অভিযানের পাশাপাশি তৎকালীন বাংলা সরকার এক লক্ষ টাকা মঞ্জুর করে কলেজের নিজস্ব ভবনের জন্য। অর্থসংগ্রহ অভিযানে জেলাশাসক অশোক মিত্র, রণজিৎ ঘোষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে মালদহ ম্যাঙ্গো ইমপ্রুভমেন্ট কমিটি কলেজের জন্য এক লক্ষ টাকা দান করে। (শেষাংশ আগামিকাল)

(লেখক গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Malda College Platinum jubilee year
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE