সেতুটা রক্ষণাবেক্ষণের দায় কার ছিল? —ফাইল চিত্র।
দু’দিন কাটতে চলল। ধ্বংসস্তূপ তন্ন তন্ন করা হয়ে গিয়েছে। হতাহতের হিসেব কষা শেষ। কিন্তু দায়টা কার, এখনও জানা গেল না। মাঝেরহাটের ব্রিজটা এ ভাবে পড়ে গেল কার গাফিলতিতে? বোঝা গেল না এখনও।
সেতু বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের এখানেই লিখেছেন যে, এ বার অপ্রিয় সত্যটা বলার সময় এসেছে। যথার্থ বলেছেন। যতই অপ্রিয় হোক, অপরাধীর নামটা সর্বসমক্ষে হেঁকে বলে দেওয়াটা আজ সর্বাগ্রে জরুরি। কিন্তু শুধু ওইটাকে বাদ রেখে বাকি সব কিছু হচ্ছে। বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচ্চারণের সূত্র ধরে তাই আজ মনে পড়ছে আর্ষবাক্যে পরিণত হওয়া আর এক পঙ্ক্তির কথা— রাজা তোর কাপড় কোথায়? উলঙ্গ হয়ে পড়া রাজার সামনে গিয়ে তাঁর কাপড়টার খোঁজ নেবে যে শিশু, সে-ই আজ নিরুদ্দেশ। কোথাও তার খোঁজ মিলছে না। অতএব প্রশ্নটাও উঠছে না।
বেহালার তরতাজা প্রাণ সৌমেন বাগ আচমকা হারিয়ে গিয়েছেন পৃথিবী থেকে। মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় শ্রম দিতে আসা প্রণব দের নিথর শরীরটা ধ্বংসস্তূপের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে। মুহূর্তে হাহাকার উঠে গিয়েছে পরিবারগুলোয়। আরও কতজন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছেন এ হাসপাতাল বা ও হাসপাতালে! আশঙ্কায়, উদ্বেগে প্রতিটা মুহূর্ত কাটছে পরিজনদের। কিন্তু কেউ জানতে পারছেন না, কার জন্য এই কান্নার রোলটা উঠল। কেউ বলতে পারছেন না, কে দায়ী।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দার্জিলিঙে ছিলেন। ফিরেছেন। দুর্ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণও করেছেন। তার পরে নানা সমস্যা এবং সম্ভাবনার কথা শোনা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে। সেতুর বয়স অনেক, পুরনো সেতুগুলির নথিপত্র ঠিক মতো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, মাঝেরহাটের সেতুটির পাশে মেট্রোরেলের কাজ চলায় পাইলিং-জনিত কম্পনে ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে সেতুটির— এমন নানা কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে যত রকম তত্ত্ব উঠে আসছে, সেই সব তত্ত্বই গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। কিন্তু দিনের শেষে কোনও নামই উঠে আসেনি।
সেতুটা রক্ষণাবেক্ষণের দায় কার ছিল? সেতুতে কোনও সমস্যা হলে প্রথমেই কাকে জানানোর কথা ছিল? সেতুটার কোনও বিপদ হলে সর্বাগ্রে কার ডাক পড়বে? এই প্রাথমিক দায়বদ্ধতাটুকু তো অন্তত নির্ধারিত ছিল। কে তিনি? কার উপরে ন্যস্ত ছিল দায়িত্ব? কোন মন্ত্রী? কোন আমলা? কোন দফতর? এটুকু তো সরকার অবশ্যই জানে। তা হলে সেই ব্যক্তি বা সেই বিভাগকে প্রশ্নটা করা হচ্ছে না কেন? কান টানলেই তো মাথার খোঁজ মিলে যাবে। কী এমন কঠিন কাজ? কিন্তু কানটাই টানা হচ্ছে না। কোন কানটা টানা উচিত, সেটাই নাকি বোঝা যাচ্ছে না। আদৌ কি বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে কথাগুলো? ধোঁয়াশাটা যে নিদারুণ কৃত্রিম, তা না বোঝার মতো নির্বোধ তো জনসাধারণ নন!
আরও পড়ুন
পূর্ত দফতরের গাফিলতিতেই এত বড় দুর্ঘটনা, মত বিশেষজ্ঞের
সেতু রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যে ছিল পূর্ত দফতরের কাঁধে, সে কথা তো অস্বীকার করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তা হলে প্রশ্ন হল, সে দফতর কি দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করেছে? সেতুর স্বাস্থ্যে সমস্যা নেই— মাত্র ছ’মাস আগের প্রতিবেদনে পূর্ত দফতর তা নিশ্চিত করেছিল বলে জানা যাচ্ছে। যে সেতু ছ’মাস আগেও ঠিক ছিল, তার পক্ষে কি এমন আচমকা দেহ রাখা সম্ভব? কোনও অস্বাভাবিক দুর্যোগের মুখে পড়ে এমনটা হল, তা-ও তো নয়! তা হলে কী ভাবে? ছ’মাস আগে পূর্ত দফতরের যে ইঞ্জিনিয়ার ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন, তাঁকে এ বার প্রশ্ন করা হোক তা হলে। কোনও উচ্চবাচ্যই নেই কারও মুখে সে প্রসঙ্গে।
সেতুর রেলিঙের জরাজীর্ণ দশা। সেতুর গায়ে গজিয়ে ওঠা উদ্ভিদ জগৎ যেন কোনও ভাবী অরণ্যের অঙ্কুর। সেতুর নানা অংশ থেকে খসে গিয়েছে কংক্রিট। এই সেতু ‘স্বাস্থ্যবান’ ছিল? মাত্র ছ’মাস আগেও! ভাবলেই শিহরণ খেলে যায় চৈতন্যের প্রবাহে।
শিহরণ আরও খেলবে, আরও অনেক বিপর্যয় আমাদের অপেক্ষায় থাকবে, আরও অনেক হাহাকার উঠবে, আর্তনাদ ছিটকে আসবে, যদি আজও প্রশ্নটা তুলতে না পারি, যদি আজও অপ্রিয় সত্যটা বলতে না পারি।
রাজা তোর কাপড় কোথায়? শিশুর সারল্যে এই প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার মতো কেউ আর রয়েছেন কি না, তা হয়তো আমাদের কারওরই জানা নেই আজ। কিন্তু বাস্তবতাটা না বোঝার মতো নির্বোধ তো কেউ নন। মুখ বুজে থাকতে থাকতে, যন্ত্রণা গিলে নিতে নিতে, সব দুর্ভোগ সইয়ে নিতে নিতে দুর্যোগ যে এক দিন সহনসীমা ছাড়িয়ে চলে যাবে অনেক দূর, সেটুকু তো অন্তত আঁচ করতে পারছেন প্রত্যেকেই। এর পরেও চোখে চোখ রেখে জবাবটা চাইব না? দায়ী কে— এখনও জানতে চাইব না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy