মহাত্মা গাঁধী। —ফাইল চিত্র
আজ মহাত্মা গাঁধীর জন্মদিনের সার্ধশতবার্ষিকীতে দেশে বিদেশে নানা স্মরণ অনুষ্ঠান হবে। এই সব অনুষ্ঠানে অনেকেই গাঁধীজিকে বসাবেন দেবতার আসনে, যেমন বসিয়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে তাঁর অগণিত সমর্থকেরা। আবার অনেকেই এতে যোগ দেবেন না— গাঁধীজিকে পছন্দ করেন না এমন লোকেরও অভাব নেই। যে কোনও ঐতিহাসিক ব্যক্তির স্মৃতিচারণাই বিতর্কিত বিষয়। গাঁধীজির ক্ষেত্রে বিতর্কগুলি আরও তীব্র।
বিতর্কের শুরু তাঁর জীবৎকাল থেকেই। এক দিকে, আলবার্ট আইনস্টাইন থেকে রোম্যাঁ রোলাঁ-র মতো মনীষীরা ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ। রবীন্দ্রনাথও। রাজনৈতিক মতানৈক্য সত্ত্বেও নেতাজি ‘জাতির জনক’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। অন্য দিকে, সমালোচকেরও অভাব ছিল না। অম্বেডকর থেকে চার্চিল অনেকেই তাঁর উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী নাথুরাম গডসে-র অসন্তুষ্টির ফলে প্রাণ হারাতে হয়েছিল গাঁধীজিকে।
সাম্প্রতিক কালেও পেরি অ্যান্ডারসন থেকে অরুন্ধতী রায়— অনেকের লেখাতেই নানা বিষয়ে গাঁধীজির সমালোচনা রয়েছে। ইদানীং কালে গাঁধীজির উপর যত বই ও প্রবন্ধ বেরিয়েছে, তাতে বহু বিষয়েই তাঁর চিন্তা ও কাজের চুলচেরা বিচার আছে। জাতপাত ও অস্পৃশ্যতা নিয়ে তাঁর মতামত, মহিলাদের সম্বন্ধে ও যৌনতা প্রসঙ্গে তাঁর ধারণা ও অবস্থান, অহিংসার দর্শন ও তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্ব, পুঁজিবাদীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এবং সর্বোপরি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর মনোভাব— প্রতিটি বিষয় নিয়েই ঐতিহাসিকরা নানা প্রশ্ন তুলেছেন। অর্থাৎ গাঁধীজি সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না কখনওই। এবং তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিতর্কগুলির তাৎপর্যও অস্বীকার করার উপায় নেই।
স্মৃতিচারণার রাজনীতিও (পলিটিক্স অব রিমেমব্রেন্স) তাঁকে রেহাই দেয়নি। সম্প্রতি ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকে তাঁর মূর্তি সরানো হল আফ্রিকা মহাদেশের অধিবাসীদের প্রতি তাঁর বর্ণবৈষম্যমূলক মনোভাবের অভিযোগে। দক্ষিণ আফ্রিকাতে থাকাকালীন গাঁধীজি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের চালু করা বর্ণবৈষম্যের ধারণার বশবর্তী হয়ে ভারতীয়দের আফ্রিকাবাসীদের চাইতে উন্নত জাতি বলে মনে করতেন। কিন্তু পরবর্তী কালে ১৯৩০-এর দশকে তিনি সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, আর তাই জোমো কেনেয়াট্টা থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা, হাওয়ার্ড থুরম্যান থেকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র তাঁর গুণমুগ্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁর আন্দোলন থেকে প্রেরণা লাভ করেন। কিন্তু স্মরণের রাজনীতিতে তার কোনও তাৎপর্য নেই। ঠিক যেমন গডসের পূজারিদের কাছে মূল্য নেই ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গাঁধীজির অবদানের!
গাঁধীজির মতো বিতর্কিত ব্যক্তিত্বকে নিয়ে স্মৃতিচারণার রাজনীতি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কেউ তাঁকে আত্মসাৎ করবেন, কেউ ধিক্কার দেবেন। কিন্তু ঘটনা হল, মূর্তি সরিয়ে বা পিচবোর্ডের প্রতিকৃতিতে গুলি চালিয়ে ভারত ও পৃথিবীর ইতিহাসে গাঁধীজির অবদানকে অস্বীকার করা বা মুছে দেওয়া যাবে না।
গাঁধী-জীবনীকার জুডিথ ব্রাউন লিখেছেন যে সবাই হয়তো গাঁধীজির সব বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হবেন না, কিন্তু তাঁর কিছু কিছু মত মেনে নিতে অনেকেই সম্মত হবেন। একটা কথা বলা যেতেই পারে। একবিংশ শতাব্দীর অস্থির পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশ যখন উগ্র জাতীয়তাবাদী ও কর্তৃত্বকামী রাষ্ট্রক্ষমতার দিকে এগিয়ে চলেছে— তখন গাঁধীজির রাজনৈতিক দর্শন ও গণআন্দোলনের কিছু দিক আমরা একটু ফিরে দেখতে পারি।
রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে গাঁধীজির চিন্তা ক্রমশ বিবর্তিত হয়েছে। সেই আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। কিন্তু উল্লেখ করা যেতেই পারে যে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান, জাতি বা ‘নেশন’-এর একটি নতুন সভ্যতা-ভিত্তিক সংজ্ঞা উদ্ভাবন। নবজাগরণ-পরবর্তী ইউরোপীয় চিন্তায় নেশন-এর সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় ভৌগোলিক অঞ্চল, ধর্ম, ভাষা বা বিশেষ জনগোষ্ঠীর পরিচয়ের ভিত্তিতে। ‘আমরা’ ‘ওরা’র বিভেদটা বিশেষ ভাবে চিহ্নিত হয়। বহুধাবিভক্ত ভারতীয় সমাজকে এমন কোনও সঙ্কীর্ণ সংজ্ঞায় বাঁধা যাবে না বলেই গাঁধীজি একটি বৃহত্তর সামুদয়িক সংজ্ঞার কথা ভাবলেন, যার ভিত্তি—ভারতীয় সভ্যতা। হিন্দ স্বরাজ (১৯০৯) গ্রন্থে ‘নেশন কে?’— এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘শুধু সেই সব ভারতীয়, যাঁরা বিবেকবুদ্ধির সঙ্গে বিশ্বাস করেন যে ভারতীয় সভ্যতাই সর্বশ্রেষ্ঠ’। গাঁধীজির চিন্তায় এই সভ্যতা কোনও সময় বা ভৌগোলিক সীমারেখায় সীমাবদ্ধ ধারণা নয়। ‘বিদেশিদের আগমন এই নেশন-কে ধ্বংস করে না, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বর্জন করে তাঁরা এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যান। একটি দেশ তখনই জাতি হয়ে উঠতে পারে যখন সেখানে এই অবস্থা বর্তমান থাকে।’ তাঁর সহচিন্তক রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, শক-হুন-পাঠান-মোগল সবাই এই জাতি-দেহে লীন হয়ে যান। এই ‘দেশ’ বা ‘জাতি’-র মূল ভিত্তি হল মানুষ, শুধুমাত্র ভৌগোলিক অঞ্চল নয়।
জাতির এই সভ্যতা-ভিত্তিক সংজ্ঞার মধ্যেই নিহিত ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিশেষত্ব, যা তাকে পশ্চিমের সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ থেকে আলাদা করে। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করতে গিয়ে এলি কেদুরি বলেছিলেন ওটা হল দেশভক্তি (পেট্রিয়টিজ়ম) আর বিদেশি-বিদ্বেষের (জ়েনোফোবিয়া) সংমিশ্রণ, অর্থাৎ অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। তুলনায় গাঁধীজি ও রবীন্দ্রনাথ যে সভ্যতা-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের দিশা দেখিয়েছিলেন তা অনেক বেশি মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। বর্তমান পৃথিবীকে এই মৌলিক চিন্তা নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে।
গাঁধীজির কাছে এই জাতির মুক্তির আদর্শ ছিল স্বরাজ। কিন্তু তাঁর স্বরাজ শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বশাসন নয়, ইংরেজদের বাদ দিয়ে ইংরেজি শাসনব্যবস্থা তাঁর কাম্য ছিল না। তাঁর স্বরাজের মূল ধারণাটি হল আত্মশাসন, যার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে তাঁর অহিংসা আর আত্মসংযমের চিন্তা। প্রত্যেক মানুষ যদি নিজেকে সংযত করে নৈতিক পথে চলেন তবেই সমাজ ও রাষ্ট্র সুষ্ঠু ভাবে চলতে পারে। গাঁধীজির রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে ধর্মের অত্যধিক সংমিশ্রণের অভিযোগ তোলেন অনেক সমালোচক। কিন্তু তাঁর আবেদন ছিল ধর্মীয় নৈতিকতার প্রতি। তাঁর ধর্মচিন্তা বিভাজনের পথ দেখায় না। হিন্দু অথবা মুসলমান হওয়ার সঙ্গে ভারতীয় হয়ে ওঠার কোনও বিরোধ রাখেননি তিনি।
পশ্চিমি গণতন্ত্রের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না গাঁধীজি। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের শ্রেণিস্বার্থ ও দলীয় রাজনীতির কথা বেশি ভাবেন, সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেন না। তাই নির্বাচন ও প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের পাশাপাশি সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স বা অহিংস আইন অমান্য আন্দোলনের একটা পরিসরের প্রয়োজন তিনি অনুভব করেছিলেন। কারণ তাঁর কাছে রাষ্ট্রের আইনের উপরেও আছে ঈশ্বরের আইন, অর্থাৎ বৃহত্তর নৈতিকতা। অহিংস পথে রাষ্ট্রের অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়।
তাঁর এই প্রতিবাদের মূলমন্ত্র সত্যাগ্রহ। সত্য যদি পক্ষে থাকে তবে অহিংস পথেই পরাক্রান্ত শাসকের মোকাবিলা সম্ভব। এমন প্রতিরোধ করতে হলে যে শক্তি দরকার তা পেশির শক্তি নয়, আধ্যাত্মিক শক্তি, যা অর্জনের জন্য প্রয়োজন সত্যাগ্রহের আত্মসংযম। ঔপনিবেশিক শাসক যদি ভারতীয়দের পুরুষত্বহীন ভেবে থাকে, তবে গাঁধীজি পুরুষত্বের নতুন সংজ্ঞা দিলেন, যেখানে পেশির শক্তির থেকে আধ্যাত্মিক শক্তি বেশি কার্যকর ও মূল্যবান।
আর তাই গাঁধীজির অগণিত সমর্থক তাঁর মধ্যে দৈবশক্তি কল্পনা করেছিলেন। গাঁধী টুপি মাথায় থাকলে ব্রিটিশ পুলিশের বুলেট তাঁদের স্পর্শ করবে না! এই বিশ্বাস তাঁদের বুলেট থেকে বাঁচাতে পারেনি, কিন্তু তাঁদের ভীতির প্রাচীরটি ভেঙে দিয়েছিল। অসংখ্য নিরস্ত্র মানুষ তাঁদের ভয় জয় করে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন স্বাধীনতার দাবিতে।
ভারত এবং বিশ্বের ইতিহাসে গাঁধী তাই শুধুমাত্র এক জন ব্যক্তি নন, একটি ধারণা। অসম শক্তিশালী অনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র মানুষের নৈতিক প্রতিরোধের ধারণা। ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়, ধারণাটিকে এত সহজে মুছে ফেলা যায় না।
ইতিহাস বিভাগ, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটন, নিউজ়িল্যান্ড
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy