Advertisement
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
Tirupattur Woman

পদবিহীন নাগরিক

আমাদের এই ভারত সব ধর্ম, সব বর্ণের মানুষের মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠবে— স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রনায়কেরা তো এই অঙ্গীকারই করেছিলেন। কিন্তু সেই ভারত আজ কোন পথে? গাঁধীজি যে ‘রামরাজ্য’র স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছিলেন, তাতে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে একসঙ্গে পথ চলার কথা তিনি বলেছিলেন। কিন্তু ভারত তাঁর কথা শোনেনি। ভিন্ন পথে গিয়েছে। পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত আজ টলমল। আর তাই এমন অদ্ভুত এক তামসী অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আরও বেশি করে স্মরণে আসে পরশুরাম এবং তাঁর গোত্রের মানুষদের কথা। লিখলেন বন্দনা ভৌমিক স্নেহা নিজে একজন আইনজীবী। তবু এই লড়াইয়ে সাফল্য অর্জন করতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হল ন'বছর! স্নেহার পদাঙ্ক অনুসরণ করলে সমাজে কী কী অরাজকতা দেখা দিতে পারে, তা নিয়ে তর্ক-বির্তক চলতে থাকুক, আমরা বরং একটু পিছন ফিরে তাকাই। 

স্নেহা।

স্নেহা।

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২০ ০০:৫৮
Share: Save:

তামিলনাড়ুর মেয়ে স্নেহা ভারতের প্রথম 'ধর্মহীন নাগরিক' -এর মর্যাদা লাভ করেছেন। সুতরাং তিনি এখন ভারতের পদবিমুক্ত এক নাগরিক। আমাদের এই ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, নাস্তিকতা এখানে 'অপরাধ' নয়। স্নেহা নিজে একজন আইনজীবী। তবু এই লড়াইয়ে সাফল্য অর্জন করতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হল ন'বছর! স্নেহার পদাঙ্ক অনুসরণ করলে সমাজে কী কী অরাজকতা দেখা দিতে পারে, তা নিয়ে তর্ক-বির্তক চলতে থাকুক, আমরা বরং একটু পিছন ফিরে তাকাই।

১৮৭০ সালে পূর্ব ছত্তীসগঢ়ের চরপাড়া গ্রামে জন্মান পরশুরাম। জাতিতে চামার। তিনি নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শেখেন। নিজে পড়াশোনা করা ছাড়াও পরশুরামের একটা নেশা ছিল আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে তুলসীদাসের 'রামচরিতমানস' পাঠ করে শোনানো। সময়টা ১৯০৭ সাল, এক দিন এই চামারের ছেলের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করার স্পর্ধা দেখে রাগে উন্মত্ত হয়ে দশরথ সিংহ নামের এক জমিদার দলবল নিয়ে গিয়ে পরশুরাম ও তাঁর নিরীহ শ্রোতাদের প্রচণ্ড ভাবে প্রহার করে। এই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যে সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরশুরাম এই অপমান ও তাঁদের এই ভাবে শারীরিক নিগ্রহের কারণে সুবিচার চেয়ে রায়পুর আদালতে মামলা ঠুকে দিলেন দশরথ সিংহের নামে। ১৯১২ সালের ১২ অক্টোবর আদালতের রায় বের হল। আদালতের রায়ে দশরথ সিংহ ও তার অনুচরেরা জেলে যেতে বাধ্য হয়। আর ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীর হয়ে 'সেশনস জজ ' ঘোষণা করলেন, এই দিন থেকে ভারতের যে কোনও মানুষকে যে কোনও উপায়ে উপাসনা করার আইনি অধিকার দেওয়া হলো। এবার আদালতের এই রায়কে অস্ত্র করে পরশুরাম অন্ত্যজদের বাঁচার মতো করে বাঁচতে শেখালেন। তাঁর প্রথম কাজ হল, দলের সবাইকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা। সমাজে তাঁদের নীচে পড়ে থাকার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি সবাইকে বোঝালেন— লেখাপড়া শিখলে এবং আত্মমর্যাদাবোধ জাগলে তাঁরাও আর সবার সমান হতে পারবেন।

আমরা জানি তুলসীদাস বর্ণিত 'রামচরিতমানস' -এর রাম একজন সৎ মানুষ। তিনি ছিলেন সমাজের বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষদের ত্রাতা এবং তাদের কাছের মানুষ। এই 'রামচরিতমানস' পাঠে ঋদ্ধ পরশুরামের চোখে রাম ছিলেন সাম্যের প্রতীক। অচিরেই পরশুরাম ও তাঁর অনুগামীরা 'রামনামি' নামে চিহ্নিত হয়ে গেলেন সমাজে । কিন্তু এই রামনামিদের পৃথক কোনও ধর্মমত নেই, নেই কোনও রামমন্দির বা বিগ্রহ। বস্তুত এঁদের ঈশ্বরে বিশ্বাসও নেই, এঁরা আদ্যন্ত নাস্তিক।

মনে রাখতে হবে, সময়টা ছিল ১৯১২ সাল। গাঁধীজি তখনও ভারতে এসে পৌঁছাননি। সেই সময়ে জল অচল, অচ্ছুত চর্মকার সম্প্রদায়ের মানুষ এই পরশুরাম তাঁর অনুগামীদের মধ্যে এমন এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন যে, এঁরা জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে প্রথমেই নিজেদের পদবি ত্যাগ করে সকলেরই নামের শেষে একই 'রাম' পদবি ব্যবহার করতে শুরু করেন। তবে সাবালক হওয়ার পর কোর্টে গিয়ে নিজেদের পছন্দমতো পদবি নামের সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার স্বাধীনতাও সকলের রয়েছে। রামনামিরা নিজেদের শরীরে এক বা একধিক রামনাম উল্কি করিয়ে প্রথম নাস্তিকতায় দীক্ষা নেয়।

এই কাহিনি যত সহজে বলা গেল পরশুরাম ও তাঁর অনুগামীদের পক্ষে কাজটি তত সহজ ছিল না। তা আদালত যে রায়-ই দিক। তাঁদের এই নাস্তিকতা সমাজ সহজে মেনে নেয়নি। তবে অচঞ্চল সাহস ও আত্মপ্রত্যয় নিয়ে তাঁরা নিজেদের বিশ্বাসে অটল থেকেছেন আর ভিতরে ভিতরে নিজেদের তৈরি করেছেন।

প্রত্যেক রামনামি পরিবার তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিল প্রথম থেকেই। আর সেই জন্যই আজ এই সব রামনামি পরিবারের এই প্রজন্মের ছেলেমেয়ের স্কুল, কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি পেতে বা বিধানসভার সদস্য হতে কোথাও আটকাচ্ছে না। কারণ, আমাদের সংবিধানে তো ধর্মের কারণে কোনও বৈষম্য করা সম্ভবই নয়।

কিন্তু এত ক্ষণ ধরে এই রামনামি সম্প্রদায় ও তাঁদের অধ্যক্ষ পরশুরামের কথা কেন বলছি? তার কারণ, দিন বদলের স্বপ্ন দেখাতে পরশুরামেরা আজও ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক। ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আমরা আজও পৃথক করতে পারিনি স্বাধীনতার এই ৭৪ বছর পরেও। এই একুশ শতকের ভারতের নাগরিকদের এখনও তার ধর্ম রাষ্ট্রের কাছে ঘোষণা করতে হয়। জানাতে হয় জাতিগত অবস্থান । কিন্তু কেন? কেনই বা তামিলনাড়ুর স্নেহাকে ধর্মহীন হতে লড়াই করতে হল দীর্ঘ নয় বছর? এই সব প্রশ্ন আমাদের মনে যে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে তা দূর করার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রেরই। রাষ্ট্রের পক্ষে তো ধর্মনিরপেক্ষ থাকাই মঙ্গলের। আমাদের এই ভারত সব ধর্ম, সব বর্ণের মানুষের মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠবে, স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রনায়করা তো এই অঙ্গীকারই করেছিলেন। কিন্তু সেই ভারত আজ কোন পথে? গাঁধীজি যে 'রামরাজ্য'র স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছিলেন, তাতে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে একসঙ্গে পথ চলার কথা তিনি বলেছিলেন। কিন্তু ভারত তাঁর কথা শোনেনি। ভিন্ন পথে গিয়েছে। পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত আজ টলমল। আর তাই এমন অদ্ভুত এক তামসী অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আরও বেশি করে স্মরণে আসে পরশুরাম এবং তাঁর গোত্রের মানুষদের কথা। আত্মসঙ্ঘাতে দীর্ণ এই বিপন্ন সমাজকে বদলাতে, আমাদের পথ দেখাতে আলোর মশাল হাতে হয়তো আসবেন সেই রকমই কোনও বিকল্প এক চারিত্রমূর্তি ।

আপাতত আমরা অপেক্ষায় থাকব আর নিজেদের তৈরি করে তুলব তাঁর সঙ্গে পথ চলার উপযুক্ত মানুষ হিসেবে।

তথ্যঋণ: 'নাস্তিকের রামনাম' –– জয়দীপ মিত্র। সঙ্গের ছবিতে স্নেহা।

অন্য বিষয়গুলি:

MA Sneha Religion Caste Tamilnadu Tirupattur Woman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy