এ বার ‘নব্য অযোধ্যা’। এক শত মিটার উঁচু রামের মূর্তি যে পবিত্র ভূমির প্রবাহিণী ঐতিহ্যশালিনী সরযূ নদীর তীরে অতন্দ্র প্রহরায় থাকিতে চলিয়াছেন। যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে আপাতত এই নূতন চমক তৈরি হইতেছে। আগামী ১৮ অক্টোবর দীপাবলি উৎসবের ঘোষণার মধ্যে প্রকাশ পাইবে এই পরিকল্পনা। নদীর তটে এত বড় প্রতিমূর্তি, সুতরাং ঝামেলা অনেক, পরিবেশবিষয়ক কাগজপত্র লাগিবে, ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল-এ পাঠাইতে হইবে। তবে যোগী আদিত্যনাথের প্রকল্প রুখিবার ক্ষমতা দেশের কোনও ট্রাইবুনালের নাই। যে রাজ্য সরকারের নব্য অযোধ্যা নির্মাণের লক্ষ্যে ১৯৬ কোটি টাকার মধ্যে ১৩৪ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকার নিজ হাতে বরাদ্দ করিয়া দিয়াছে, যে রাজ্যের সরকারি পর্যটনের ৬৩ পৃষ্ঠা ব্যাপী রিপোর্টে তাজমহলের এক অক্ষরও স্থান হয় নাই, যেখানে আদালতের তোয়াক্কা না করিয়াই বাবরি মসজিদ চত্বরে রামমন্দির বানাইবার বিশালকার পাথরের চাঁই-সমূহ ইতিমধ্যেই জমা হইতেছে, সেখানে পরিবেশের দুশ্চিন্তায় রামের স্ট্যাচু নির্মাণ ব্যাহত হইবে, এমন কি ভাবাও যায়? সরকারি পরিকল্পনার মধ্যে একটি রামকথা গ্যালারিরও ঠাঁই হইয়াছে, অযোধ্যাই যে রামের জন্মস্থান, তাহার ‘ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ’ সেখানে বিন্যস্ত হইবে। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এমনিতেই অতি মাত্রায় স্ট্যাচুপ্রেমী। প্রধানমন্ত্রী মোদী ক্ষমতায় আসা ইস্তক বহু নূতন নায়কের স্ট্যাচুর সূচনা হইয়াছে: বল্লভভাই পটেল, বি আর অম্বেডকর, দীনদয়াল উপাধ্যায়, ছত্রপতি শিবাজী। যোগীর সৌজন্যে এ বার রামও যুক্ত হইলেন। অর্বাচীন ইতিহাসবোদ্ধারা যাহাই বলুন, নব্য ভারতের নব্য জাতীয়তাবাদ বিলক্ষণ জানে, এই স্ট্যাচু হিস্টিরিয়ার পিছনে তাড়না ও প্রণোদনাগুলি কী ও কেমন।
একশত মিটার রামমূর্তির উৎসও ওই তাড়নাতেই খুঁজিতে হইবে। দিনকাল মন্দ। বর্তমান সরকারের এতগুলি মনোমুগ্ধকর ধুয়ার সব কয়টিই ধোঁয়ায় মিলাইবার জোগাড়। তিন বৎসর ধরিয়া কত চেষ্টা চলিল। অচ্ছে দিন, স্বচ্ছ ভারত, মেক ইন ইন্ডিয়া, ডিজিট্যাল ইন্ডিয়া, ডিমনিটাইজেশন দিয়া দুর্নীতির ‘ডিমন’ বা ভূত তাড়ানো, সর্বজনীন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, কিছুই জমিল না। জাতীয়তাবাদ বলিয়া যত লাফালাফি, জাতীয়তাবাদের পুঁজিটি আবার ইহাদের কোনও কালেই তত ভাল নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়করা সকলেই বিপক্ষ দলের দেবলোকের অন্তর্গত, বিজেপির নিজস্ব দেবলোকটি এখনও কাঁচা মাটির। অথচ যে দলের সমাজ-অর্থনীতির অ্যাজেন্ডা এত দুর্বল, বড় মাপের চোখ-ধাঁধানো প্রতীক বা প্রতিকৃতি ছাড়া তাহাদের চলেই বা কী করিয়া? শেষ পর্যন্ত সেই নিরাপদতম আশ্রয়, স্মরণযোগ্য ইতিহাস হইতে বাহির হইয়া গিয়া স্মরণাতীত পুরাণকাহিনির জাঁকজমক চাকচিক্যের খোঁজ। সেই আদি অকৃত্রিম মহাপৌরাণিকের শরণ।
যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যের হাসপাতালে শিশুমড়ক এখন আন্তর্জাতিক সংবাদ। অপরাধ-মাফিয়ার জয়জয়কারে আইনশৃঙ্খলা পর্যুদস্ত। অ্যান্টি-রোমিয়ো ব্রিগেডের দাপটে সাধারণ্যের ক্ষোভ। বিভিন্ন অঞ্চলে দলে দলে দলিত ধর্মান্তরণ। দলিততোষণের ব্যর্থতা ঢাকিতে নূতন দলিত আইকন রাজা সুহেলদেবের স্ট্যাচু উদ্বোধনে স্বয়ং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহকে আহ্বান। নোটবন্দিতে রাজ্যের বিবিধ শ্রেণির নাভিশ্বাস। এমতাবস্থায়, কী কেন্দ্রে কী রাজ্যে, রামচন্দ্র না রাখিলে কে রাখিবেন? পরিস্থিতি এমনই যে নোবেলজয়ী রিচার্ড থেলার কে কী কেন না জানিয়াও খুঁজিয়া-পাতিয়া বাহির করিতে হয় নোটবন্দি লইয়া তিনি কেমন আগ্রহ দেখাইয়াছিলেন। খুচরার এই মাত্রাতিরিক্ত আধিক্যই বুঝাইয়া দেয় বৃহৎ অ্যাজেন্ডাটি ধারে বা ভারে কোনও ভাবেই কাটিতেছে না। এক শত মিটার হইলেও এই মূর্তিটিও ওই খুচরারই দলে। নব্য সংযোজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy