Advertisement
০৭ নভেম্বর ২০২৪
Letters to the Editor

সম্পাদক সমীপেষু: জীবনের পাঠ

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪ ০৭:৫৮
Share: Save:

শৈবাল বসুর ‘শিক্ষক বনাম সমাজমাধ্যম’ (১৯-১০) প্রবন্ধটি অত্যন্ত সময়োপযোগী। বিদ্যালয় নিঃসন্দেহে সামাজিকীকরণের শক্তিশালী মাধ্যম। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের আন্তর্জাল সর্বস্ব দুনিয়ার সর্বগ্রাসী আধিপত্যের আবহে সমাজমাধ্যমের মাধ্যমে সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়াটি সকলের অজানতে চোরাগোপ্তা পথে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। আন্তর্জাল শিক্ষার্থীর বহুবিধ চাহিদা নিঃসন্দেহে মেটায়। কিন্তু বিশুদ্ধ জ্ঞানাহরণের আড়ালে অল্পবয়সিদের মনের মধ্যে শোষিত হচ্ছে অজস্র নেতিবাচক উপাদান, যা তার মানসিক গঠনকে প্রভাবিত করছে অভিভাবক-শিক্ষকদের চেয়েও ঢের বেশি। বস্তুত, অতিমারি কাল থেকেই ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন বিদ্যালয় শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠছে। সামাজিকীকরণের এ-হেন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রে এক দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার জন্ম দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) দীর্ঘ সময় ধরে স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহারের কুফল হিসেবে অল্পবয়সিদের মধ্যে ‘টেক্সট নেক সিনড্রোম’ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। গত ১০ অক্টোবর ছিল বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এ বারের মূল ভাবনা ছিল ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য’। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতেও শিক্ষক-শিক্ষিকারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিবিড় আত্মিক সম্পর্কের বন্ধনে তাদের ভবিষ্যৎ মানসিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করে তুলতে পারেন। নিছক পাঠ্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তার মধ্য থেকেই শিক্ষার্থীদের মানসিক দৃঢ়তার পাঠ দিতে পারেন তাঁরা। কৈশোরের সঙ্গত জিজ্ঞাসাগুলিকে ভর্ৎসনা করে থামিয়ে না দিয়ে সহজ আলোচনা করলে শিক্ষার্থীদের মন স্বাভাবিক বিষয়গুলি সম্পর্কে জানতে পারে। এতে বিকৃত মানসিকতা তৈরিকে অনেকাংশে আটকানো সম্ভব।

জীবনশৈলীর পাঠ নিয়ে অহেতুক সঙ্কীর্ণতা কিশোর মনকে দূরে সরিয়ে রাখে বলেই হয়তো অল্পবয়সিদের জিজ্ঞাসু মনের ফাটলে অপরাধপ্রবণতা ধীরে ধীরে জল-হাওয়া পায়। তাই, বিদ্যালয়কে নিছক পরীক্ষা বৈতরণি পার করার মাধ্যম হিসাবে না দেখে জীবনের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে পরিণত করার সময় এসেছে।

দীপশংকর রায়

শ্রীরামপুর, হুগলি

সত্য-মিথ্যা

শৈবাল বসু তাঁর প্রবন্ধে আমাদের সমাজের একটি ক্ষয়িষ্ণু দিক তুলে ধরেছেন, যা কোনও ভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার নয়। নিজেদের শরীর চেনা শুরু হয় সাধারণত বয়ঃসন্ধির অনেক আগে থেকেই। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে কৌতূহল। মগজের দখল নিতে থাকে টেলিভিশন, সিনেমা, ডিজিটাল দুনিয়ার গভীর যৌনগন্ধী উপস্থাপনা। আজ একটা পাঁচ বছরের শিশুও আমাদের অনেকের চেয়ে ভাল বোঝে স্মার্টফোনের কায়দাকৌশল— অনলাইনের অবাধ দুনিয়া। অথচ, ঠিক কোন ধরনের যৌন হিংসার শিকার সে হতে পারে যে কোনও সময়, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সচেতনতা ও ধারণা তার থাকে না। এক দিকে যৌন সচেতনতার বা সংবেদনশীলতার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি আর অন্য দিকে ডিজিটাল মাধ্যমে বিকৃত যৌনতার নানাবিধ উপকরণ পরিস্থিতির জটিলতা বাড়িয়ে তুলছে।

যৌনশিক্ষা আসলে মূল প্রতিপাদ্য ছাড়িয়ে আরও বহু দূরে যাওয়া একটি বিষয়। ক্ষুদ্র তাত্ত্বিক বিষয় ছাড়িয়ে প্রকৃত বাস্তবতাকে পাঠ্যক্রমের আওতায় আনাটাই এর মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সাম্প্রতিক সমস্যাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। থাকবে বিভিন্ন আইন এবং নীতিশাস্ত্রের অনুশাসনের আলোকে যৌন-নৈতিকতার পাঠ। শেখানো হবে ড্রাগ শক্তিবর্ধক নয়, জীবননাশক। পাঠ্যক্রমে থাকুক সেলফোন-আসক্তির বিপদের আলোচনা— কী ভাবে বিশ্বময় ইন্টারনেটের মাধ্যমে এক দল অপরাধী শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে, যাতে বলি হচ্ছে অসংখ্য কিশোর-কিশোরী। সাইবার-বুলিং, মুক্তিপণ আদায়কারীদের ফাঁদ, প্রেমের নামে প্রতারণা, গোপন ক্যামেরায় ছবি ও ভিডিয়ো তোলার চক্র, নারী ও শিশু পাচারকারীদের চক্রান্ত, জঙ্গিদের শিকারে পরিণত হওয়ার বিপদের মতো সাম্প্রতিক সমস্যার চুলচেরা বিশ্লেষণের পাঠ থাকবে। মূলত এই সমাজবিজ্ঞানকে সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য করা হলে আলাদা ভাবে ‘সেক্স এডুকেশন’ নামের কোনও অধ্যায়ের আর প্রয়োজন হয় না।

তবে নিয়মিত নতুন নতুন সমস্যার নিরিখে পাঠ্যক্রমের সংস্কারও প্রয়োজন। ঠিক কেমন হবে সে পাঠ্যক্রমের বিষয়তালিকা, কোন বয়স থেকেই বা আলোচনা হবে সে সব এবং কোন বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা সেগুলো পড়াবেন— এ সব প্রশ্নে আরও সুগভীর চিন্তাভাবনা, আলোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে। এর জন্য সমাজের বিবিধ ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ এবং স্বাধীন চিন্তাশীল মানুষের এগিয়ে আসা আশু প্রয়োজন।

সৌম্য বটব্যাল

দক্ষিণ বারাসত, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

মনের পরিবর্তন

শৈবাল বসু-র প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। সম্ভবত প্রবন্ধকার ‘বিদ্যালয় স্বাস্থ্য কর্মসূচি’ সম্পর্কে অবহিত নন। শিক্ষণ-কেন্দ্রিক যে সকল সমস্যা তিনি তুলে ধরেছেন সেই সকল সমস্যা ও তার মোকাবিলার উপায় আলোচিত হয় বিদ্যালয় স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে। ইউনিসেফ ও রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য মিশনের সহায়তায়, রাজ্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দফতর ও রাজ্য বিদ্যালয় শিক্ষা দফতরের যৌথ উদ্যোগে ‘বিদ্যালয় স্বাস্থ্য কর্মসূচি’ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফি সপ্তাহে শ্রেণিপিছু একটি করে ক্লাস রাখার কথা বলা হয়েছিল। সেইমতো স্কুলগুলিতে কম-বেশি ক্লাসও হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্রতি মাসে গুগল শিট ফিল-আপ করে সংশ্লিষ্ট দফতরে রিপোর্ট পাঠাতে হয় বিদ্যালয়গুলিকে। অন্য দিকে, প্রতিটি বিদ্যালয়ে ‘মনের কথা’ লেবেল সেঁটে একটি চিঠির বাক্স রাখার প্রস্তাব করা হয়, যেখানে শিক্ষার্থীরা পরিচয় গোপন রেখে তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারে। তাই প্রবন্ধে উল্লিখিত ‘শিক্ষক হিসাবে বিশেষ প্রশিক্ষণের পরিসরেও কখনও আসে না লিঙ্গ রাজনীতির কোনও পাঠ’— কথাটি কতখানি যুক্তিযুক্ত, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

‘বিদ্যালয় স্বাস্থ্য কর্মসূচি’র মুখ্য উদ্দেশ্য হল শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কৈশোরকালীন সমস্যা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সজাগ করা। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গাইডলাইন হিসাবে একটি প্রশিক্ষণ ও সহায়ক পুস্তিকাও দেওয়া হয়েছিল। পুস্তিকাটি এমন ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা, নেশাদ্রব্যের অপব্যবহার প্রতিরোধ, প্রজনন স্বাস্থ্য ও এইচআইভি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা, ইন্টারনেট ও সমাজমাধ্যমের সংযত ও নিরাপদ ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে সম্যক ধারণা গড়ে তোলা যায়। তা ছাড়া, রাজ্য সরকারের উদ্যোগে বিদ্যালয় শিক্ষা বিভাগ ‘উজ্জীবন চর্চা’ নামে ভার্চুয়াল ওয়েবিনার-এর মাধ্যমে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নানা বিষয়ে সহায়তা করে। যেমন, কী ভাবে এআই লেখাপড়ায় সাহায্য করতে পারে এবং তার সতর্ক ব্যবহারবিধি, ডিজিটাল প্রতারণা থেকে সাবধান হওয়ার উপায় ইত্যাদি। তবে, এর ব্যতিক্রম যে ঘটছে না, এমন নয়।

পরিশেষে, প্রবন্ধকার ‘পিরিয়ড’ না বলে ‘শরীর খারাপ’ বলার মধ্যে যে আপত্তি জানিয়েছেন, তা সঙ্গত। কিন্তু ‘পিরিয়ড’ না বলে তার প্রচলিত বাংলা শব্দটি বললে আপত্তি কোথায়? তার মানে প্রবন্ধকার নিজেও সাহসী হতে পারলেন না। তসলিমা নাসরিন ‘ছেলেবেলা’ শব্দটিকে পাল্টে মেয়েদের ক্ষেত্রে ‘মেয়েবেলা’ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তাতেও কি সমাজ সংশোধন সম্ভব হয়েছে? নামে কী আর আসে যায়! সর্বাগ্রে দরকার মানসিকতার পরিবর্তন।

অজয় ভট্টাচার্য

বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা

অন্য বিষয়গুলি:

Letters to the editor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE