সাবরমতীর জল হইতে উড়িয়া ধারোই বাঁধের জলে নামিল সমুদ্রবিমান। সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া আসিলেন গুজরাতের বিকাশপুরুষ। জনতার দিকে স্মিত মুখে হাত নাড়িলেন এবং অম্বাজি-র মন্দিরের দিকে চলিয়া গেলেন। নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদীর শেষ অঙ্ক। জানা গেল, নির্বাচনী প্রচারে মন্দির যাওয়া লইয়া তাঁহার বা দলের আপত্তি নাই, একমাত্র আপত্তি ছিল রাহুল গাঁধীর ধর্মীয় পরিচয় বিষয়ে। জানা গেল আরও অনেক কিছু। এক, মোদী নিজের রাজনীতিতে এমনই ভরসা হারাইয়াছেন যে, সি-প্লেনের সস্তা (আর্থিক দিক হইতে নহে, সি-প্লেন চাপিতে বিস্তর খরচ) চমকের উপর ভরসা করিতে হইতেছে। যে ‘গুজরাত মডেল’-এর দামামা তাঁহাকে ২০১৪ সালে দিল্লির মসনদে বসাইয়াছিল, গোটা নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদী তাহার নাম উচ্চারণ করিলেন না। তাঁহারা পাকিস্তানকে জড়াইলেন, রাহুল গাঁধীর ধর্মীয় পরিচয় লইয়া প্রশ্ন করিলেন, জিএসটি-র হার কমাইলেন— কিন্তু, গুজরাত মডেলের কথা আসিল না। দীর্ঘ দিনের বিজেপি-শাসনের পরও কেন সাধারণ গুজরাতির বাড়িতে ‘বিকাশ’-এর পা পড়ে নাই, কেন হরেক মানব উন্নয়ন সূচকে গুজরাত নিতান্তই দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারিতে থাকে, রাজ্য চষিয়া বেড়াইলেও নরেন্দ্র মোদী কোথাও ঘুণাক্ষরেও এই প্রসঙ্গগুলি উত্থাপন করেন নাই।
ভক্তরা বলিতে পারেন, যে রাজ্যের নেতা স্বনামধন্য দশলাখি স্যুট পরিয়া বিশ্বদরবারে যান, সি-প্লেনের পুষ্কক রথ হইতে অবতীর্ণ হন, তাঁহার রাজ্যে উন্নয়ন তো বুলেট ট্রেনে চাপিয়া আসিতেছে। অতএব, গরিব মানুষের চোখ ধাঁধাইয়া দিয়া নেতারা নামিয়া আসিলে লজ্জার কোনও কারণ নাই। ‘লজ্জা’ বস্তুটিরই আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে কি না, সেই প্রশ্নটিও উঠিতে পারে। রাজনীতিতে যে কদর্য ব্যক্তি-আক্রমণের স্তরে নামাইয়া আনা হইয়াছে, সেই প্রসঙ্গটি যদি আপাতত বাদও রাখা যায়, নরেন্দ্র মোদীর ভোট দিয়া ফিরিবার দৃশ্যটি ভুলিবার নহে। তাঁহার দল রাহুল গাঁধীর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের নিকট নালিশ ঠুকিয়াছিল যে, প্রচারপর্ব মিটিবার পর তিনি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়া বিধিভঙ্গ করিয়াছেন। সেই মামলায় নোটিস জারি হইয়াছে কী হয় নাই, নরেন্দ্র মোদী তাঁহার ভোট দিয়া ফিরিবার যাত্রাটিকে কার্যত ‘রোড শো’-তে পরিণত করিলেন। প্রতিপক্ষের আপত্তিকর কাজ লইয়া যে অভিযোগ করিতেছেন, নিজে নির্দ্বিধায় তাহার দ্বিগুণ আপত্তিকর ঠিক সেই কাজটিই করিয়া ফেলিবার মধ্যে যে আশ্চর্য নির্লজ্জতা আছে, নরেন্দ্র মোদীরা ইদানীং তাহাও ভুলিয়াছেন।
গুজরাত ভোটের ফলাফলের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও তাহাকে কেন্দ্র করিয়া অনন্ত জল্পনার অবসান হইতে চলিয়াছে। কিন্তু ফল যাহাই হউক, তাহা একটি সত্যকে বদলাইতে পারিবে না। যে সাবরমতীর জলে মোদীর সমুদ্রবিমান নামিল, তাহার তীরেই একটি আশ্রম আছে। তাহার প্রাণপুরুষ বলিতেন, ‘যে নীতি দরিদ্রতম মানুষটির চোখের জল মুছিতে পারে, শুধুমাত্র তাহাই ন্যায্য।’ তিনি ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির কামরাতেই সফর করিতেন। তাঁহার পরিধান ছিল একটি খাটো ধুতি। তিনি অধুনা ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর পোস্টারে চশমারূপে সংস্থিত হইয়াছেন। বিকাশপুরুষের অন্তরে যে তাঁহার ঠাঁই নাই, তাহা বোধ করি বড় বেশি প্রকট হইয়া গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy