ব্যতিক্রমী: রাঘব চাড্ডা ‘আপ’ দলের পক্ষে দিল্লির তরুণ প্রার্থী।
সকলেই আমরা চাই এক নিরাপদ ও স্বাধীন মতপ্রকাশের অবকাশ। প্রতি পাঁচ বছরের চক্রে নির্বাচনী নির্ঘণ্টের নির্দিষ্ট দিনগুলিতে আমরা ভীষণ সজাগ। সেই আদর্শ পরিবেশের ব্যাঘাত ঘটলেই আমাদের চেঁচামেচি। অর্থাৎ, আমরা অত্যন্ত উদ্বুদ্ধ সমানাধিকারের আদর্শে। আমরা ওই নির্দিষ্ট দিনগুলোতে চাই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ। আবার সেই আমরাই কিন্তু বাকি দিনগুলোয় নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনে, বুঝে না-বুঝে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে চলি। সুযোগসুবিধা মতো ব্যবহার করে নিই ক্ষমতার অধিকার, যে যেখানে পারি।
আধুনিকতার দায়ভার অনেক। আমরা যারা মনে করছি যে আমাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হল, তারা যদি একটু নিজেদের দিকে তাকাই? পাড়ার মোড়, খেলার মাঠে, হাটে-বাজারে সকলের সঙ্গেই সমান ভাবে ওঠা-বসা করছি তো? নিজের অজান্তেই ‘আমরা, আমাদের মতো’দের সঙ্গে বাকিদের আলাদা করে দিইনি তো? শুরুটা তো হয় ইস্কুল থেকেই। ছেলেমেয়েরা কোন ইস্কুলে ভর্তি হবে, ঠিক কোন নিরিখে— আমরা বাছ-বিচার করি। আজকাল সমতার যুগ। ইস্কুলের প্রতি ক্লাসেই আছে সেই ‘মার্জিন’-এর বাইরের ছেলেমেয়েদের বাধ্যতামূলক অ্যাডমিশন। ঠিক কেমন হয় এক একটা ক্লাসরুমের ভিতরের বা ইস্কুলের খেলার মাঠের গল্প? মসৃণ ভাবে কি এই দুই দল মিলেমিশে যায়? কাদের কখন কী ভাবে এই অধিকারবোধ মাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের আধুনিক জীবন, সে সব কিন্তু আমাদের আলোচিত প্রাত্যহিক জীবনের বাইরেই থেকে যায়।
এই কথাগুলো বর্তমান নির্বাচনী স্লোগান ও শব্দের মধ্যে নিয়ে আসার একটা কারণ আছে। পাঁচ বছর অন্তর আমরা যে উন্নত, সহনশীল, মানবিক ভারতবর্ষ গড়ার ইভিএম লাইনে দাঁড়াতে যাই, সেই দেশের খোলনলচেতে আসলে বইছে এক অসহনশীল অমানবিক শ্বাসপ্রশ্বাস। প্রাত্যহিক জীবনে ছোটখাটো অধিকার কেড়ে নেওয়া আর পারস্পরিক অসম্মানের সম্পর্কের যোগসাজশেই গড়ে উঠছে এই দেশ-কাল-সমাজ। কঠিন তত্ত্বকথা হলেও বলি, আদর্শ আধুনিক সমাজ কিন্তু সার্বিক সমতা-নির্ভর কোনও ব্যবস্থা নয়, সেই জীবনযাপনের বুনিয়াদি ধাপটি হল সৌভ্রাত্র আর সমধর্মিতার সম্পর্ক। সে দিকে এগোতে হলে নিজের জগতের বাইরে ‘অপর’ বা অন্যের আশা-আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রশ্ন আসেই। ভাবতেই হয় যে, এই অসম সামাজিক ব্যবস্থায় আমার অবস্থান যদি কাঠামোর নীচের দিকে হত, তা হলে আমি কী ভাবতাম আর কী করতাম।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এ দেশে দারিদ্রের সঙ্গে পদে পদে থাকে অবমাননা। তাই জন্যই সৌভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার অভাবে আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করতে শিখি না। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা বাঁকে লুকিয়ে থাকে চোরাগলি। পর পর সাজানো কতকগুলো অর্থবাহী বলয় নিয়ে বাস্তবতা আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। সবচেয়ে নিকটতম বলয়ে আমরা পরিচালিত হই ব্যবহারিক আর কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে।
আর এখানেই জিতে যায় রাজনৈতিক শ্রেণি। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের জেতা-হারার কোনও ব্যাপার নয় এটা। নাগরিক সুবিধার জন্য আমরা নির্ভর করতে থাকি গ্রামের মোড়ল বা পাড়ার দাদাদের কাছে। কতকটা যজমানি ব্যবস্থার মতো কার্যকর এই সম্পর্ক বহাল থাকে এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মৌরসিপাট্টার দৌলতে। এই কাঠামোর মাথায় বসে থাকে এক এক জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ‘ফেথফুল’ আর ‘ফিয়ারিং’— বিশ্বাসী এবং সন্ত্রস্ত আমজনতার অস্তিত্বের সঙ্গেই এই রাজনৈতিক শ্রেণির ভাগ্য জড়িয়ে। অস্বচ্ছতা আর অস্পষ্টতা হল এই শ্রেণির সাফল্যের ঢাল।
অতিশি মারলেনা, ‘আপ’ দলের পক্ষে দিল্লির আর এক তরুণ প্রার্থী।
দুর্নীতি বনাম স্বচ্ছতার বিতর্ক ভারতীয় ভোটারদের অনেকটা গা-সওয়া অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কেননা, অভিযোগ বা পাল্টা-অভিযোগ এ সব এই সমাজে কোনও দৃষ্টান্তমূলক প্রাতিষ্ঠানিক পরিণতি পায় না। প্রতিষ্ঠানের উপর বিশ্বাস টলে গিয়েছে বলেই তৈরি হয়েছে এই ‘ফেথফুল’ আর ‘ফিয়ারিং’ ভোটারসমাজ। তাঁরা খুঁজতে চান এমন কোনও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান যারা ব্যবহারিক চাহিদা মিটিয়ে দেবে।
অবশ্যই এর বাইরে আছে পাঁচ বছর অন্তর নতুন ম্যানিফেস্টো। ম্যানিফেস্টো কি বদলে দিতে পারে দিন-আনা দিন-খাওয়া সামাজিক চালচিত্র? কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষায় রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের কথা যদি ফিরে আসে, কৃষকের ন্যায্য পাওনার কথা যদি ম্যানিফেস্টোয় জায়গা করে নেয়, নিশ্চিত ভাবেই আমরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সমাজক্ষেত্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে চলতে পারি। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের এই সত্তর বছরের পথ-চলা আমাদের অবিশ্বাসী করে তুলেছে। রাজনৈতিক ভাষ্য আমাদের কানে যেন ‘সংলাপ’ হয়ে বাজে আজকাল।
হিংসাশ্রয়ী ভেদাভেদ, ধর্মীয় উন্মাদনার বদলে সহিষ্ণু ভারতীয় অন্তরাত্মার খোঁজে একটু একটু করে একটা জনস্রোত তৈরি হতে দেখা যাচ্ছিল সেই ২০১৬ সালে। ওই বছর জানুয়ারিতে রোহিত ভেমুলার ঘটনা এবং ফেব্রুয়ারিতে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে কানহাইয়া কুমারদের গ্রেফতারের পর ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে রাজধানীর রাজপথে একটা ভিন্ন ঘরানার রাজনীতি নেমে আসে। নানা স্লোগানে মুখরিত হয়ে দিল্লির রাস্তা ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে। নানা রঙের পতাকার নীচে একটা বিকল্প বহুযাত্রিক প্রতিরোধ-বয়ানের সন্ধান তৈরি হয়। দিল্লির ছাত্র-যুব নেতৃত্বের পাশাপাশি সুদূর তামিলনাড়ু, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রের গ্রামীণ কৃষক নেতৃত্বের স্বর মিলেমিশে যায়, আর মৌলিক কিছু অধিকার রফার দাবি তুলে আনে। হতেই পারে স্থূল নিবার্চনী অঙ্কে, সংখ্যার মারপ্যাঁচে এই সম্ভাবনার সর্বভারতীয় অস্তিত্ব নেহাত দুর্বল। তবু, স্রেফ সংখ্যার হিসেব-নিকেশ না হয়ে জোরটা যদি হত যুক্তি বা বিকল্প সমাজচেতনার হিসেবে, তা হলে ভারতীয় রাজনীতিতে আমাদের আজ সেই একই নিজের নিজের জাগির জিইয়ে রাখার ‘গণতান্ত্রিক’ প্রতিযোগিতা দেখতে হত না। ‘জাগির’ অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারার সামনে সাংবিধানিক ন্যায়-যুদ্ধের লড়াইকে পিছিয়ে যেতে দেখতে হত না।
যে অধিকার হরণের কথা দিয়ে শুরু এই লেখা, তার পুনরুদ্ধারের একটা আধার হল ভারতীয় সংবিধান। পিছিয়ে যেতে যেতেও, সংসদীয় গণতন্ত্রের বাস্তব সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও, আমরা শুনতে পারি ব্যতিক্রমী মননশীল স্বর। সর্বগ্রাসী দেশাত্মবোধ আর রাষ্ট্রপ্রেমের ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ বা বড় আখ্যানটাকে তাল ঠুকে নির্বাচনী প্রতিযোগিতাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে সক্রিয় হতে পারে যুব আবেগ আর বুদ্ধিবৃত্তির উদ্যম। লাঞ্চবক্স হাতে, ল্যাপটপ কাঁধে ছাব্বিশ বছর বয়সি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট দক্ষিণ দিল্লির আম আদমি প্রার্থী রাঘব চাড্ডা বা পূর্ব দিল্লির সপ্রতিভ অতিশি মারলেনা নির্বাচনী মঞ্চে এক ঝলক টাটকা বাতাস বইয়ে দিতে পারে। তাই এলিটিজ়মের অভিযোগ এনে নাক না সিঁটকে খেয়াল করা ভাল, কী ভাবে সরকারি স্কুলের খোলনলচে বদলে একটা নিঃশব্দ বিপ্লব এনে দিয়েছে দিল্লি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের উপদেষ্টা অক্সফোর্ড-ফেরত অতিশি। এতে সমাজের পিছিয়ে থাকা পরিবারের ছেলেমেয়েদেরই উপকার হচ্ছে, সমানে সমানে লড়াই করতে পারার জায়গায় তারা কেউ কেউ আসতে পারছে।
এ ভাবেই সারা ভারতেই ছড়িয়ে আছে এক ব্যতিক্রমী ভারত, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের প্রাক্তন সহ-সভাপতি শেহ্লা রশিদ তাঁর সহকর্মী প্রাক্তন সভাপতির সমর্থনে সুদূর কাশ্মীর থেকে বিহারের প্রত্যন্ত বেগুসরাইতে ছুটে গিয়ে বলতে পারেন, আমরা নানা মত নানা পথের শরিক ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু কানহাইয়া কুমার আমাদের শিখিয়েছিলেন একসঙ্গে পথ চলতে। নির্ভীক বিরুদ্ধতার বয়ানে আমরা পেয়েছি বলিষ্ঠ জিগ্নেশ মেবাণী, স্বরা ভাস্কর বা প্রকাশ রাজকে। লড়াইটা কোনও বিপরীত দলের প্রার্থী বা বিরুদ্ধ দলের সঙ্গে নয়। লড়াইটা কিছু মৌলিক অধিকার আর সাংবিধানিক শর্ত প্রতিষ্ঠা করার।
প্রসঙ্গত, গুজরাত দাঙ্গার পরবর্তী এক সমীক্ষায় পড়েছিলাম এক সংখ্যালঘুর সাক্ষাৎকার। বক্তব্য ছিল: যদি আমরা ভোট না দিলে নিশ্চিন্তে ঘরসংসার করার আশ্বাস পাই, তবে না-হয় ভোট দিতেই যাব না। এখন, আমাদের প্রশ্ন— সেই অধিকারবিমুখ ‘নিরুপদ্রব’ ভারতবর্ষই আমরা কি চাইছি?
(সমাজতত্ত্বের শিক্ষক, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy