এ বারের তথ্য চমকপ্রদ। ইদানীং যে সব ভোটপর্ব হয়েছে, মহিলাদের যোগদানের হার অবাক করা। এমনটা আগে দেখা যায়নি। কী ভাবে? ২০১৪ সালে পুরুষ ভোটারদের শতকরা হিসেব ছিল মহিলা ভোটারদের শতকরা হিসেবের থেকে মাত্র ১.৮% বেশি। কিছু দিন আগেও ছবিটা অন্য রকম ছিল। ২০০৪ সালে, পুরুষ ভোটাররা ছিলেন মহিলা ভোটারদের থেকে ৮.৪% বেশি। ১৯৬২ সালে এই সংখ্যাটাই ছিল ১৬.৭%। ১৯৬২ সালে ৪৬.৬৩% মহিলারা ভোটদান করেছিলেন, যে সংখ্যা বদলে ২০১৪ সালে হয়েছে ৬৫.৫৩%।
হঠাৎ কী হল? না কি হঠাৎ নয়? কোনও বিশেষ ঘটনার জন্য কি এই পরিবর্তন? শোনা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর আকস্মিক হত্যার পর রাজীব গাঁধীর প্রতি মহিলাদের সহানুভূতি ছিল ভোটের ফলাফলের কারণ। এমনও শোনা যায় যে পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনের পিছনে বিশেষ কারণ ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রেণিনির্বিশেষে মহিলাদের অকুণ্ঠ সমর্থন। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট বুথফেরত সমীক্ষা সুলভ নয়, আর পছন্দের প্রার্থী নির্বাচনের কারণ খুব খুঁটিয়ে ব্যাখ্যার চল এখনও এ দেশে নেই।
তবে, প্রার্থীসাপেক্ষ বা ঘটনাসাপেক্ষ ভোটদানে পরিবর্তন এলে তাকে সত্যিকারের পরিবর্তন বলা চলে না। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে, শুধু লোকসভা নির্বাচন নয়, বিভিন্ন রাজ্যের (অরুণাচল প্রদেশ, গোয়া, কেরল, মণিপুর) নির্বাচনেও মহিলাদের ভোটদানের হার বেড়েছে এবং পুরুষদের ভোটদানের হারকে তা অতিক্রম করে গিেয়ছে, তখন তা বলার মতো ব্যাপার বইকি। নির্বাচন কমিশনের সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে প্রত্যেক ১০০০ পুরুষ ভোটার পিছু ৭১৫ জন মহিলা ভোটার ছিলেন ১৯৬২ সালে। ২০০৯ সালে তা হয়েছে প্রতি ১০০০ পুরুষ ভোটার পিছু ৮৮৩ মহিলা ভোটার। ভারতীয় নারীরা কি হঠাৎ রাজনীতিসচেতন হয়ে পড়লেন?
দেশের সমীক্ষা কিন্তু অদ্ভুত তথ্য দিচ্ছে। মিলন বৈষ্ণব ও জেমি হিল্টনের সমীক্ষার মতে মহিলারা বেশি ভোট দিতে যাচ্ছেন কারণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাঁদের ‘টার্গেট’ বা লক্ষ্য করে কর্মসূচি তৈরি করছে। আমরা দেখতেই পাচ্ছি, রাজ্যের ‘কন্যাশ্রী’ ‘রূপশ্রী’ প্রকল্প, কিংবা কেন্দ্রের ‘উজ্জ্বলা’ ও ‘জীবিকা’ প্রকল্প। কার্নেগি এনডাওমেন্টের সমীক্ষার মতে মহিলারা চার পাশ সম্পর্কে আগের থেকে বেশি ওয়াকিবহাল হয়েছেন এবং এ ব্যাপারে সোশ্যাল মিডিয়ার অবদান অনস্বীকার্য।
এই পার্থক্য আরও অবাক করার মতো যখন আমরা মেয়েদের ভোট থেকে ভোটের মেয়েদের দিকে তাকাই। মেয়েদের ভোট কত হারে বেড়েছে, সেটা তো দেখলাম। কিন্তু ভোটের মেয়েরা? নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে কি? তথ্য বলছে ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থীদের মাত্র ৮.১% ছিলেন মহিলা। এই সামান্য সংখ্যাও ভারতের ইতিহাসে মহিলা প্রার্থীদের শতকরা হিসেবে সবচেয়ে বেশি। ১৯৬২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থীদের মাত্র ৫ শতাংশেরও কম ছিলেন মহিলা।
আর সত্যিই অবাক করার বিষয় হল রাজ্যভেদে এর পার্থক্য। লিঙ্গসাম্য কম এমন রাজ্যে মহিলা প্রার্থীদের সংখ্যা বেশি! অর্থনীতিবিদ মুদিত কপূর ও শমিকা রবির গবেষণা অনুযায়ী লিঙ্গসাম্যের তালিকার উপরের দিকে থাকা ভারতীয় রাজ্যে, যেমন কেরলে, মহিলাদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংখ্যা কিন্তু হরিয়ানার মতো লিঙ্গসাম্যের তালিকার নীচের দিকে থাকা রাজ্যের তুলনায় কম।
এই তথ্যের সঙ্গে কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক আছে কি? হয়তো আছে। মহিলা নেত্রী দ্বারা পরিচালিত দল বলেই হয়তো ২০১৯ সালে তৃণমূলের প্রার্থী-তালিকার ৪১% মহিলা, যা ভারতের মধ্যে উচ্চতম এবং নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
যদি সামগ্রিক চিত্রের দিকে তাকাই? এখনও লোকসভায় মহিলা প্রতিনিধির সংখ্যার শতকরা হিসেব ১১.৬%। এই সংখ্যা ১০% অতিক্রম করেছে মাত্র ২০০৯ সালে। সারা দেশে মহিলা বিধানসভা সদস্যের শতকরা হিসেব মাত্র ৯%।
এই আপাতবিরোধিতা কেন? মহিলারা ভোটদানে, সরকার গঠনে ভূমিকা নিচ্ছেন কিন্তু প্রার্থী হচ্ছেন না? ভোটদান হল পরোক্ষ মতপ্রকাশ, ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যক্ষ সিদ্ধান্ত— তাই? তা ছাড়া ভোট দিতে যাওয়া একটা সাময়িক বা তাৎক্ষণিক ঘটনা। ওইটুকু ‘ছাড়’ মহিলারা হয়তো কোনও মতে জোগাড় করে নিচ্ছেন। সরাসরি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগদানের অধিকারই যেখানে দূরঅস্ত্, সেখানে ভোটে দাঁড়ানো তো অনেক দূরের কথা।
বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভাগ্য নির্ধারিত হতে চলেছে এই নিয়ে ১৭ বার। কাগজের পাতায়, টিভিতে ঘোমটা-টানা বা বোরখা-পরা মুখদের ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমরা আশ্বস্ত হব, মহিলারাও এগিয়ে এসে ভোট দিচ্ছেন এই ভেবে। সেলেব্রিটিদের দেখানোর ফাঁকে ক্যামেরা তাঁদেরও দেখাবে, যেন এটা একটা বিশেষ ঘটনা, যেন এমনটা হওয়ার কথা নয়। আর তার মধ্যেই, নারীর আপন ভাগ্য জয় করার কথা, বিপ্লবের সেবাদাসী হওয়া বা না-হওয়ার কথা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে আরও এক বার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy