প্রতীকী ছবি।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মুহুরি নদীর তীর থেকে এসেছেন বছর-পঁচিশের অভিজিৎ পাল। দেও নদীর পাড় থেকে আঠাশ বছরের শ্যামল দেবনাথ। আর আঠারমুড়া পাহাড় থেকে ঝাঁপানো খোয়াই নদী ছুঁয়ে থাকা মাটি থেকে তেইশ বছরের মন্দিরা বর্মণ। নদীধারের এই তিন জনই ছড়িয়ে পড়েছেন পশ্চিমবঙ্গের নদীপাড়ের শহরে। জয়সিংহ-অপর্ণার রাজ্য ত্রিপুরা থেকে এসেছেন ওঁরা পেশার কারণে। তিনজনই কাশফুলে উতল, পুজোর গন্ধে পাগল এবং তিনজনেরই শরৎ কাটে ইউনিফর্ম পরে, ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে, অপারেশন থিয়েটারে, জরুরি বিভাগে। ওঁরা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।
রাত নিঝুম। হাসপাতালের লম্বা করিডর। দু’পাশে পর পর ঘর। সেখানে রোগীরা। কেউ ঘুমে আচ্ছন্ন। কারও যন্ত্রণা ঘর ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে করিডরে। করিডরের ধারে নার্সিং ডেস্ক। দেওয়ালে সাজানো বেড নম্বর-সহ লাল আলো। তা জ্বলে উঠলেই রোগীর কাছে যাওয়া। করিডরের সুদূর প্রান্তে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে কোনও রোগী। ঘুম আসে না। জানলার কাচের ওপারে জনপদ, আবাসন, ইউক্যালিপটাস, বট আর একটা পুজোমণ্ডপ। আলোকোজ্জ্বল, মাইকরণিত। উদাস চোখে তাকিয়ে রোগী। হঠাৎ পিঠে হাত। ‘ঘুম আসছে না? বেশ, এখানে না দাঁড়িয়ে ওদিকটায় যান। ওদিক থেকে আবছা নদী দেখা যায়। এখানে দাঁড়ালে আরও মনখারাপ হবে!’’ মনখারাপ না করার পরামর্শ যাঁর, সেই অভিজিতের সাত বছর ধরেই এই দিনগুলোয় মনখারাপ হয়। সাত বছর পুজো নেই তাঁর। একটু আগে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। মা কেঁদে ফেলেছেন।
দক্ষিণ ত্রিপুরার প্রত্নভূমি পিলাক। সেখানেই বেড়ে ওঠা অভিজিতের। মা-বাবা-বোন। কৃষক পরিবার। ধান, আলু, আনাজ। এই পেশায় আসা জ্যাঠতুতো দিদিদের পেশা ভালবেসে। তাঁরা নার্স। দ্বাদশ পাশ করার পর নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা অভিজিতের। এখন তাঁর স্বপ্নের মতোই লাগে সাত বছর আগের শরৎগুলোকে! চাঁদা তুলতে বেরোতেন, ঠাকুর দেখতে যেতেন। ঠাকুর অবশ্য গত বছরও দেখেছেন। নবমীনিশিতে কয়েকটা। গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে। বন্ধুনীও নার্স। ডিউটি সামলে মণ্ডপ-হপিং যে বস্তু, তিনিও বোঝেন।
শ্যামলের স্ত্রী নার্স নন। তবে বুঝে গিয়েছেন, উৎসবের সময় তাঁর বরের ছুটি ডুমুরের ফুল। ঊনকোটির পেচারথলের গ্রামে বাড়ি শ্যামলের। মা, বাবা, স্ত্রী। ত্রিপুরায় নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা। তারপর নিজের রাজ্য ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে। তাঁর কথায়, ‘‘এই খাটনির পর পুজো নিয়ে আর এনার্জি থাকে না!। তবে মনকেমন করে!’’ কারণ, মা-বাবা এবং ‘ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে’। এখন যে-শ্যামল রক্তচাপ মাপার যন্ত্র নিয়ে রোগশয্যার পাশে আবির্ভুত হচ্ছেন, তিনিও চাঁদা তুলতে বেরোতেন, প্রতিমা আনতেন। গ্রামের পুজোর সেই ছবির সঙ্গে শহরের মিল খুঁজে পান না শ্যামল। তবে, বুঝতে পারেন, উৎসবের মায়াটা একই সব জায়গায়।
‘‘আজ অষ্টমী না নবমী রে, বাবা? এখানে তো কিছুই বোঝা যায় না!’’ নব্বই বছরের হার্ট পেশেন্ট বৃদ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে শ্যামল জানিয়ে দেন, নবমী। পরের প্রশ্ন, ‘‘ঠাকুর দেখতে যাবি না?’’ শ্যামল বলেন, ‘‘পরের বার যাব, ঠাকুমা! তোমার সঙ্গে!’’ ফোকলা হাসিতে ইন্দির ঠাকরুণ ভেসে ওঠেন। কাশফুল জেগে ওঠে ২২৭ নম্বর বেডে। ধুনোগন্ধ পাওয়া যায়।
ঘুম না আসা রোগীটির করিডরে ঘুরে বেড়ানোর আরও একটা কারণ আছে। জানেন, রাতে ছেলেমেয়েগুলো চা-বানিয়ে খায়। এক দিন আর্জিও পেশ করে দিয়েছেন। ‘‘তোমরা যখন চা খাও, আমাকেও একটু...! কাল না হয় বলে নেব ডাক্তারবাবুকে!’’ মন্দিরারা চা বানান যখন, তাঁর জন্যও এক কাপের ব্যবস্থা হয়ে যায়। সেই কারণেই করিডরে ঘুরঘুর।
মন্দিরা কল্যাণপুর গ্রামের। পশ্চিম ত্রিপুরা। মা, বাবা, দুই দাদা, এক দিদি। এক দাদা রেলপুলিশ। অন্যজন পড়াশোনা। বাবা পোস্টমাস্টার। মা শিক্ষক। ‘‘বাবার ইচ্ছেতেই নার্স হওয়া। আমারও ইচ্ছে ছিল!’’ বাড়িতে পুজো হয় মন্দিরাদের। মহাষ্টমীতে, ঘটে। কিন্তু বড় আয়োজনে। ওঁদের ওখানে মহালয়ার ভোরে গোটা গ্রাম নেমে আসে রাস্তায়। সবার সঙ্গে সবার দেখা। মন্দিরাও নামতেন সেই শারদ মিছিলে। ছ’বছর হয়ে গেল আর নামা হয় না তাঁর। বয়ফ্রেন্ড এই শহরেই থাকেন। তিনিও নার্স। কিন্তু এখনও অবধি পুজোয় বন্ধুর সঙ্গে ‘বেরোনো’ হয়ে ওঠেনি মন্দিরার। হয় ছুটি মেলেনি। নয়তো মেলেনি ডিউটি-সময়। মনখারাপ হয় পুজোয়? মন্দিরার উত্তর, ‘‘না। রোগীদের সঙ্গে থাকতে ভাল লাগে। আমরা বরং এই সময়টায় রোগীদের সঙ্গে পুজো নিয়ে গল্প করি। তাঁদের পুজোর গল্প শুনি। ত্রিপুরার পুজোর গল্প বলি। একটু মন ভাল হয় ওঁদের!’’
নতুন জামাকাপড় পুজোয় হয় মন্দিরা-অভিজিৎ-শ্যামলদের। তবে, এখন আগের মতো আর পরা হয়ে ওঠে না সে সব। যেমন হয়ে ওঠে না রোগীদেরও। ‘‘একবার পুজোর সময় কুড়ি-একুশ বছরের একটা মেয়ে ভর্তি হয়েছিল। পুজোয় বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘোরার সব প্ল্যান ঠিক। হঠাৎ প্যানক্রিয়াটাইটিসের যন্ত্রণা। পঞ্চমী থেকে মেয়েটার সে কী মনখারাপ! আমার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল!’’ বিষণ্ণ নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মন্দিরা জানায়, মেয়েটি অবশ্য নবমীর দিন ছুটি পেয়েছিল। এ বার মন্দিরার পুজোয় ডিউটি আর ওঁর বন্ধুর বেঙ্গালুরু চলে যাওয়া পড়াশোনার জন্য।
বাইরের রং-রঙিন আলোর ঝরনা বনাম হাসপাতালের ভিতরের স্থির-নির্জন ছবি। এ দু’য়ের মিলন হওয়া নামুমকিন! বাইরে এখানে ভিতরে আসে। ভিতর বাইরে যায় না। বাইরে ভিতরে আসে উৎসবে দুর্ঘটনা বাড়ে বলে। সরকারি বা বেসরকারি— ওটি, ইমারজেন্সি, আইসিইউ উৎসব এ ভাবেই পালন করে। সেখানে পুজো প্রতিদিনের। প্রাণের পুজো, অর্চনা জীবনের। সে পুজোয় অনেক ক্ষেত্রেই লড়াইটা যমে-মানুষে। সে পুজোর ঋত্বিক চিকিৎসকেরা আর মন্দিরা, অভিজিৎ, শ্যামল, অঞ্জন, জাহির, নানভুলারা।
এ পুজোতেও নতুন কোনও রোগী আবারও দাঁড়াবেন করিডরে। আবারও কোনও অভিজিৎ তাঁকে আবছা নদীর কথা বলবেন। কোনও বৃদ্ধের হৃদয়ে আশ্বাসের অক্সিজেন জোগাবেন কোনও শ্যামল। কোনও মন্দিরা রাতদুপুরের স্পেশাল চা এগিয়ে দেবেন নির্ঘুম কোনও রোগীর দিকে। হয়তো মন্দিরার মনে পড়ে যাবে মহালয়ার ভোরে দাদাদের হাতে গরম চায়ের কাপ তুলে দেওয়ার কথা। হয়তো তার মধ্যেই বেজে উঠবে বেল, জ্বলে উঠবে লাল আলোটা, শোনা যাবে নার্স-ইন-চার্জের গলা— ‘২১৮ বাজছে। দেখো কেউ গিয়ে।’’
এ উৎসব চলবে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy